এক বছরের শাসনামলে অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির মতে, এই সরকার জনগণকে হতাশ করেছে।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: মানবাধিকারের অব্যাহত সংকটময় পরিস্থিতি’শীর্ষক এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে আসক।
সেখানে বলা হয়, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, আন্দোলনপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো নির্বিচারে গ্রেপ্তার চলছে। হেফাজতে মৃত্যু ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে; যা আগের সরকারের দমনমূলক আচরণের পুনরাবৃত্তির মতোই মনে হচ্ছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে নাগরিকের নিরাপত্তাবিষয়ক উৎকণ্ঠা চলমান রয়েছে।’
সারা দেশে উচ্ছৃঙ্খল জনতার মাধ্যমে সংঘটিত ‘মব সন্ত্রাস’-এর ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে উল্লেখ করে আসক বলছে, রাজনৈতিক প্ররোচনায় পরিচালিত বা সামাজিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত এসব সহিংস কর্মকাণ্ডে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যা মানবাধিকারের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।
আসক মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতির আরও একটি উদ্বেগজনক দিক হলো, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত দুর্বল ও সুরক্ষাহীন অবস্থা। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নিপীড়ন ও হুমকির ঘটনা আরও বেড়েছে। এমনকি ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালানো হয়েছে, যার মধ্যে লুটপাট ও জীবননাশের হুমকিও রয়েছে। এসব ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো বিচার বা শাস্তি না হওয়ায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা আরও গভীর হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠেছে অভিযোগ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নারীরা বর্তমানে এক বিস্তৃত নিরাপত্তাহীনতার আবহে জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে নারীদের মারধর, অপমান ও শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক-সামাজিক সহিংসতা এখন প্রায় নিয়মিত সংবাদে উঠে আসছে। নারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো, তাঁদের পোশাক বা আচরণ নিয়ে নৈতিকতা নির্ধারণের চেষ্টা তথা মোরাল পুলিশিং দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। নারীদের এই নিপীড়ন কেবল ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি কাঠামোগত সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, যেখানে নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।’
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ও উঠে এসেছে বিবৃতিতে।
সেখানে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যম আজ নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শত শত সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল, কৌশলে চাকরিচ্যুতি, মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা, গ্রেপ্তার, সংবাদপত্র অফিসে হামলা এবং মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার চর্চা কতটুকু বিদ্যমান—সেই প্রশ্ন বছরজুড়ে ছিল।
আসক মনে করে, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অনেক শিক্ষার্থীকে অন্যায্যভাবে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, সনদ বাতিল করা হচ্ছে; যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হুমকির মুখে পড়ছে।
তবে বিবৃতিতে কিছু আশার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মাঝে একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, বাংলাদেশ বলপূর্বক গুম থেকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এবং পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বে সংঘটিত গুমের অপরাধ তদন্তের জন্য একটি ‘গুম কমিশন’ গঠন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য দায়বদ্ধতার পথে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ পুনর্গঠন না করাটা মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করায় সাধুবাদ জানিয়েছে আসক। এই ঘোষণার মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে বলে মনে করছে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বিবৃতিতে আইনের শাসন, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ নিশ্চিতেরও দাবি জানানো হয়।