টেস্ট সিরিজে হার দিয়ে শুরু বাংলাদেশের শ্রীলংকা সফর। প্রথম টেস্ট সাবেক অধিনায়ক নাজমুল হোসেন জোড়া সেঞ্চুরিতে লড়াই করলেও দ্বিতীয় টেস্টে হারতে হয়েছে ইনিংস ব্যবধানে। প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতেও এলোমেলো বাংলাদেশ। নতুন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের শুরুটা হলো ভূতুড়ে এক ব্যাটিং ধসে, ৫ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে সমতায় ফিরলে তৈরি হয় শ্রীলংকার মাটিতে প্রথমবার সিরিজ জেতার সম্ভাবনা। কিন্তু বিধি বাম! ইতিহাস গড়া দূর, লড়াইটাও করতে পারলেন না মিরাজরা। সেই আক্ষেপ এসে ঘুচল লিটন দাসের নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টি সিরিজে।
যদিও ওয়ানডের মতো এই সিরিজও বাংলাদেশ শুরু করেছে হার দিয়েই। তবে সিরিজের পরের দুই ম্যাচে দারুণভাবে ফিরে এসেছেন লিটন নিজে আর তার দল। লংকার মাটিতে প্রথমবার হেসেখেলেই জিতল টি-টোয়েন্টি সিরিজ। এর আগে তাদের বিপক্ষে পাঁচটি দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেললেও একটিতেও জেতা হয়নি বাংলাদেশের। সাফল্য বলতে ছিল শুধু চারটি ম্যাচ জয়। এবার বদলে গেল হিসেবে। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের স্কোরলাইনে বাংলাদেশের পাশে বসেছে ‘১’।
বুধবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক লিটন এই সিরিজ জয় উৎসর্গ করেছেন ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শহীদ হওয়া ছাত্র-জনতাদের উদ্দেশ্যে। সহজেই বোধগম্য, ঐতিহাসিক এই জয়ের প্রভাব ঠিক কতখানি। বৃহস্পতিবার সকালে লিটন-তানজিদ তামিমরা দেশে ফিরেছেন টি-টোয়েন্টি সিরিজের ট্রফি নিয়ে। বিমানবন্দরে হাসিমুখেই ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা দিলেন স্কোয়াডের সবাই। এই হাসি যে স্বস্তির তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লিটনদের এই হাসির নেপথ্যে অবশ্য লুকিয়ে আছে টানা ব্যর্থতার গল্প। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে সিরিজ হার, পাকিস্তানে সফরে গিয়ে হোয়াইটওয়াশের পর শ্রীলংকায় টানা দুটো সিরিজে ব্যর্থতা। সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দারুণ চাপে ছিল বাংলাদেশ দল। আর এই দলটাও তুলনামূলক নতুন, তরুণদের দিয়ে গড়া। তাই চাপ জয় করে এই সিরিজ জেতার মাহাত্ম্যও অনেক বেশি। বাংলাদেশের সাবেক অনেক ক্রিকেটারও তাই মনে করছেন।
সব মিলিয়ে কেমন গেল বাংলাদেশের শ্রীলংকা সফর?
সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনের মতে, সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ও পারিপার্শ্বিক চাপ মিলিয়ে সফরের শেষটা বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই করেছে বাংলাদেশ।
টাইমস অফ বাংলাদেশ’কে বাশার বলেন, ‘শেষটা ভালো হয়েছে আমাদের। টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষ করেছি ভালো মতো। এই সিরিজ জেতা আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। কারণ অনেক চাপে ছিল দল, অনেক কথা হচ্ছিল। নিজেদের জন্যই এই সিরিজটা জেতা অনেক দরকার ছিল। সব মিলিয়ে সফরটা এত খারাপ যায়নি। প্রথম টেস্টটা ভালো করেছি, দ্বিতীয় টেস্টটা অত ভালো হয়নি। ওয়ানডে সিরিজে একটা ম্যাচ জিতলাম। শ্রীলংকা কিন্তু সবসময়ই আমাদের জন্য টাফ কান্ট্রি টু ভিজিট। কিন্তু দলটা নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। তো সব মিলিয়ে বলব সফরটা খারাপ যায়নি। শেষটা ভালো মতো শুরু করলাম, যেটা খুবই ভালো ব্যাপার।’
শ্রীলংকার বিপক্ষে আগে কখনো টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতা হয়নি বাংলাদেশের। চাপের মুখে ২-১ ব্যবধানে জেতা এই সিরিজে ক্রিকেটারদের মানসিক পরিপক্কতা দেখতে পাওয়ার তৃপ্তিও ঝরল বাশারের কন্ঠে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়কে অনেক বড় অর্জন হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক।
‘অনেক বড় জয়। কারণ ক্রিকেটাররা অনেক টাফ মেন্টালিটি দেখিয়েছে। ক্রিকেটাররা অনেক চাপের মুখেই ফেলে দিয়েছিলাম আমরা, বিশেষ করে মিডিয়া। এখান থেকে ফিরে আসাটা সহজ ছিল না, কঠিন কাজটা তারা করতে পেরেছে। এজন্য তাদের অনেক বড় একটা রিওয়ার্ড পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা এটাই আশা করি তাদের কাছ থেকে। আমার মনে হয় এটাই স্বাভাবিক, ক্রিকেট নিয়ে এভাবেই চিন্তা করা উচিত।’, বলেন বাশার।
আরেক সাবেক ক্রিকেটার রাজিন সালেহ, যিনি বর্তমানে কর্মরত আছে বাংলাদেশ হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি) ব্যাটিং কোচ হিসেবে। তার মতে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের বিবেচনায় বাংলাদেশ খুব খারাপ করেনি শ্রীলংকা সফরে। সফরের প্রথম দুই সিরিজের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিয়েছে, লিটনের ঐতিহাসিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়।
বাংলাদেশের শ্রীলংকা সফর নিয়ে টাইমস অফ বাংলাদেশ-কে রাজিন বলেন, ‘আমি খারাপ কিছু বলব না। সিক্সটি-ফোর্টি বলব। আমরা ভালোই করেছি, কারণ একটা সিরিজ জেতা খুবই জরুরি ছিল আমাদের জন্য। একটু খারাপ সময় যাচ্ছে। সেই সময়টা প্রত্যেকটা ছেলে মিলে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আমরা টি-টোয়েন্টি সিরিজটা জিতেছি, এটা আমাদের জন্য একটা বড় পাওয়া হলো। এটা নেক্সট সিরিজের জন্য কনফিডেন্ট বিল্ড আপ করবে।’
লংকায় প্রথমবার সিরিজ জিতে লিটন ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় এক অর্জন। সাবেক অধিনায়ক রাজিনও সুর মেলালেন তার অনুজের সাথেই, ‘এইটা অনেক বড় জয়। কারণ শ্রীলংকার মাটিতে আমরা এর আগে কখনোই সিরিজ জিতি নাই। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া, সামনে ওখানে বিশ্বকাপও আছে। এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের অনেক কাজে আসবে। এটা খুব জরুরি ছিল বাংলাদেশের জন্য।’
অম্ল মধুর অভিজ্ঞতায় শেষ হলো বাংলাদেশের শ্রীলংকা সফর। যার শুরুটা তেঁতো, মাঝটা আরো হতাশার এবং শেষটায় পরম প্রাপ্তি লিটনদের। যদিও দেশে ফিরে শ্বাস ফেলার জো নেই। আগামীকাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজের প্রস্তুতি। ২০, ২২ ও ২৪ জুলাই মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলবে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। লংকা জয়ের আত্মবিশ্বাস ঘরের মাঠে কতটা কাজে লাগাতে পারেন লিটনরা, সেটাই দেখার অপেক্ষায় সবাই।