রাজধানীর যানজটের চাপ কমাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক পয়েন্টে বিকল্প পথে গাড়ি ঘুরিয়ে দিয়ে (ডাইভারশন) দেওয়া হয়। তবে সাময়িক এই উদ্যোগ বাস্তবে কতটা সুফল আনছে—তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে অতিরিক্ত যান চলাচল ছাড়াও একই সড়কে নানান গতির যান, সারিবদ্ধতা বা লেইন অনুসরণ না করা, নগরীর কয়েকটি স্থানে রেল ক্রসিং—ইত্যাদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ছাড়াও সমন্বয়হীনভাবে বিভিন্ন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি সৃষ্টি করছে প্রতিবন্ধকতা।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মিতুল আহমেদ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করেন। টাইমস অব বাংলাদেশকে তিনি বলছিলেন, ‘আগে অফিস শেষে বাইক নিয়ে তেজগাঁও-বিজয় সরণি ফ্লাইওভার হয়ে সোজা উড়োজাহাজ সিগন্যাল হয়ে লেক রোড দিয়ে বাসায় সহজেই পৌঁছে যেতাম।’
‘কিন্তু গত ২৫ জানুয়ারির পর থেকে এই সহজ যাত্রাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন মহাখালী হয়ে বিজয় সরণি দিয়ে যেতে হয়। কারণ এখন অফিস থেকে বের হয়ে বিজি প্রেসের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে ফ্লাইওভার থেকে নেমে ফার্মগেটের কাছাকাছি গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে বিজয় সরণি হয়ে যেতে হয়। তাই এতটা পথ না ঘুরে মহাখালীর পথটা ব্যবহার করছি,’ জানান তিনি।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) তানিয়া সুলতানা টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা খুব কম গাড়ি বা বাইক পাই যারা তেজগাঁও ফ্লাইওভার হয়ে ডানদিক ব্যবহার করছে। আসলে তারা মোহাম্মদপুর বা ধানমণ্ডিতে বসবাসরত। কিন্তু সন্ধ্যার পর ফ্লাইওভারে আগের মতো যানজটে দীর্ঘ সময় নগরবাসীকে বসে থাকতে হয় না।’

‘বিজয় সরণির যানজটের জন্য কোথায় প্রভাব পড়ে, কিংবা অন্য কোন জায়গার জন্য বিজয় সরণীতে প্রভাব পড়ে সেটা বিচার বিবেচনা করে আমাদের ট্রাফিকের সাতটি ডিভিশন সমন্বিতভাবে কাজ করছে’, যোগ করেন তিনি।
এডিসি তানিয়া বলেন, ‘কোনোদিন দেখা যায় বেশি গাড়ি চলছে, আবার কোনোদিন তুলনামূলকভাবে কম চলে। কোনোদিন সড়কে একাংশ বন্ধ, কোনোদিন আরেকাংশ খোলা থাকে। কোনোদিন বিশেষ অনুষ্ঠান থাকে, কোনোদিন থাকে না। আমরা প্রতিদিনের “রুটম্যাপ” সে হিসেবে সাজাই। আবার “অনস্পট” সিদ্ধান্ত নিয়েও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।’
মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক সদস্যরা বলছেন, বিজয় সরণি পেরিয়ে উড়োজাহাজ ক্রসিং হয়ে আসা যানবাহনের চাপ সামলানো এখন বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। বিকল্প সড়ক না থাকায় সে চাপ সামলানোর বিকল্প সমাধান না পেয়ে সিগন্যাল ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষায় আটকে রাখতে হচ্ছে। যা সড়কের একদিকে জট সৃষ্টি করছে সড়কে। যদি জাহাঙ্গীর গেটের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে যানবাহনগুলোর জন্য বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে অনেকটুকু সমস্যার সমাধান হবে। সম্ভব হয়, অনেকাংশে সমাধান আসবে।’
সড়কে প্রচণ্ড চাপের প্রভাব পড়ে মেট্রোরেলেও। ফার্মগেট, পল্লবী, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। চলতি আগস্টে একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দৃশ্যত সকাল থেকেই অচল হয়ে পড়ে মহানগর। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে একসঙ্গে কয়েকটি বড় রাজনৈতিক সমাবেশ ছাড়াও এইচএসসি ও বিসিএস পরীক্ষা এবং সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস—সব মিলিয়ে রাজধানীবাসী পড়েন চরম ভোগান্তিতে।
সে সময় ফার্মগেট স্টেশনে টিকিটের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী আসিফ আলী বলেন, ‘রাস্তায় জ্যাম দেখে মেট্রো ধরলাম। কিন্তু এখানে এসেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।’
তেজগাঁও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানায়, ‘বাংলাদেশ আই হাসপাতালের’ সামনে ধানমন্ডি ২৭ এর পশ্চিমে একটি বাম লেন তৈরি করা হয়েছে। ফলে বিরতিহীনভাবে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের (পুরনো) পূর্ব দিক থেকে আসা যানবাহন বাম লেন ধরে সাত মসজিদ রোড হয়ে ইউটার্ন নিয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে পারছে, তাদের কোনো সিগন্যালে পড়তে হচ্ছে না। ফলে এখন তিনটির বদলে যানগুলোকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে মাত্র দুটি সিগন্যাল। একই সঙ্গে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সাত মসজিদ এবং উল্টোপথে যাতায়াত সহজ হয়েছে, যানজট বেশকিছুটা কমেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৬০০ পয়েন্টে চার শিফটে ২৪ ঘণ্টার ট্রাফিক সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম শিফট ভোর সাড়ে ৬টা থেকে বেলা আড়াইটা এবং দ্বিতীয় শিফট বেলা আড়াইটায় থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত চলে। তৃতীয় শিফটে রাত সাড়ে ১০টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ৩৮টি ব্যস্ত পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করে ট্রাফিক পুলিশ। আর সবশেষ চতুর্থ শিফটে রাত ২টা থেকে ভোর সাড়ে ৬টা পর্যন্ত নগরীতে মাত্র নয়টি পয়েন্টে মোতায়েন থাকে ট্রাফিক বিভাগ।
এ পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে গাবতলী বাস টার্মিনাল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মোহাম্মাদপুর বাসস্ট্যান্ড, মহাখালী বাস টার্মিনাল, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, যাত্রাবাড়ী বাস টার্মিনাল, আজমপুর ও গুলিস্তান।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
সড়ক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে ভয়াবহ যানজটের মূল কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে সড়কের স্বল্প ঘনত্ব (মাত্র ২.৫২%)। এর মাঝেই নিয়মিত তিনশ থেকে চারশ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে। সড়কের এই স্বল্প ঘনত্ব আরো কমিয়ে দিচ্ছে রাস্তায় ভাসমান দোকান। ফলে সড়কে ইউটার্ন বা ডাইভারশন করলেও যানজট কমবে না।’
‘পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনার কাঠামোগতভাবে পুনর্বিন্যাস করা গেলে যানজট হ্রাস করা সম্ভব,’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘রাজধানীর চারপাশ ঘিরে যে নদী ও জলাধার রয়েছে, তা ব্যবহার করা হলে রাস্তার ওপর চাপ কমবে। এই জলপথে হাতিরঝিলের মতো যদি ওয়াটার লঞ্চ সার্ভিস কার্যকর করা যায়, তাহলে নগরবাসীর বড় একটি অংশ এর সুবিধা নিয়ে সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবেন। এমনটা থাইল্যান্ডে করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুযোগ থাকার পরও তা আমরা করছি না।’
‘আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রোডাক্টিভির কাছে যেতে হবে,’ মন্তব্য করে এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখানে পেশাদারি লোকের সংখ্যা অনেক কম। “লোক দেখানো উন্নয়ন” করেই কিন্তু আমরা সহজ সরল সমস্যাকে অনেক জটিল বানিয়ে ফেলেছি।’
ট্রাফিক ব্যবস্থাপকদের অভিমত
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. রফিকুল ইসলাম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘‘সদিচ্ছা, সমন্বিত পরিকল্পনা ও দৃঢ় পদক্ষেপ থাকলে সীমিত সম্পদেও রাজধানীর যানজট হ্রাস করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সড়কে স্থায়ী কার্পেটিং, প্রকৃত মিড আইল্যান্ড ও ইউটার্ন নির্মাণ করা জরুরি।’
‘এছাড়া সিটি করপোরেশনের নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের পাশাপাশি সড়কের দখল রোধে কঠোর নজরদারি এবং ট্রাফিক আইনের বিষয়ে সকলের সম্মান সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে,’ যোগ করেন ডিসি রফিকুল।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) জানায়, সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর ইন্টারসেকশনসমূহের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, অবৈধ যানবাহন বন্ধ, ব্লকভিত্তিক রিক্সা চলাচল, পার্কিং লোকেশন চিহ্নিত করা ও পার্কিং সম্পর্কিত পরিকল্পনা, সিগন্যালিং সিস্টেম, ইউটিলিটি সার্ভিস নির্মাণকালীন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং ঢাকা মহানগরীর সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বৈঠক হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাই করুক, ঢাকার যানজট নিরসনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে সরকার এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষগুলোকে।