দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান আর নেই।
রোববার সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
৭৯ বছর বয়সী এই শিল্পী গত তিন দিন থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। সকালে চিকিৎসকেরা তার লাইফ সাপোর্ট খুলে দেন।
পরিবারের সদস্যরা শিল্পীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, তিনি নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ১৫ জুলাই তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত তিন দিন তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
শিল্পী হামিদুজ্জামান খান স্ত্রী ভাস্কর আইভি জামান, দুই পুত্রসহ দেশ এবং দেশের বাইরে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বরেণ্য এই শিল্পীর একক প্রদর্শনী হয়েছে ৪৭টি। হামিদুজ্জামান ২০০৬ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন। ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি ফেলো নির্বাচিত হন।
জানা গেছে, বেলা আড়াইটায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নেওয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নামাজে জানাজা হবে।
শিল্পীর দাফনের বিষয়ে পরিবারের সাথে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম।
১৯৪৬ সালের ১৬ মার্চ কিশোরগঞ্জের সহশ্রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুজ্জামান খান। তিনি ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান চারুকলা অনুষদ) থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর ১৯৭০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ২০১২ সালে অবসর গ্রহণের পর থেকে স্বাধীনভাবে শিল্পচর্চা করে গেছেন। হামিদুজ্জামান খানের প্রধান শিল্পমাধ্যম ভাস্কর্য হলেও তিনি জলরঙের ছবিতেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
হামিদুজ্জামান খান বিভিন্ন মাধ্যম ও ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ধাতু,কাঠ, সিরামিকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিরীক্ষাধর্মী অনেক ভাস্কর্য রচনা করেছেন। একটা পর্যায়ে ধাতব মাধ্যমে পাখির ভাস্কর্য সৃজনে মনোযোগী হয়েছিলেন। টিএসসি চত্বরে ধাতব মাধ্যমে করা ‘শান্তির পায়রা’ সহ পাখি নিয়ে তার অনেক ভাস্কর্য রয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অধিকাংশ ভাস্কর্যই তার হাতে করা। দেশের আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার বিকাশে তিনি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভাস্কর আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে তিনি জয়দেবপুর চৌরাস্তায় ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ভাস্কর্য নির্মাণে কাজ করেন। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রথম ভাস্কর্য। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে সার কারখানায় ‘জাগ্রত বাংলা’, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’, ঢাকা সেনানিবাসে ‘বিজয় কেতন’, মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন প্রাঙ্গণে ‘ইউনিটি’, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ‘ফ্রিডম’, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বাধীনতা চিরন্তন’, আগারগাঁওয়ে সরকারি কর্মকমিশন প্রাঙ্গণে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’, মাদারীপুরে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ হামিদুজ্জামান খানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য।
১৯৭৬ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় তিনি নির্মাণ করেন ‘একাত্তর স্মরণে’ ভাস্কর্য। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজধানী সিউলে অলিম্পিক ভাস্কর্য পার্কে ‘স্টেপস’ ভাস্কর্য স্থাপন করেন। এর পর আন্তর্জাতিক পরিসরেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ক্যানভাসে হামিদুজ্জামান খান জলরঙ ও অ্যাক্রেলিকে বিমূর্ত ধারায় ফুটিয়ে তোলেন নিসর্গ ও মানবশরীর।