রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ঘনবসতিপূর্ণ আবাস (জেনেভা ক্যাম্প) যেন মাদকের অভয়ারণ্য। মাদক উচ্ছেদে বিভিন্ন সময় সেখানে পুলিশ, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও যৌথ বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালিয়েছে। এরপরও যেন অনেকটা প্রকাশ্যেই সেখানে চলছে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও মাদকের জমজমাট ব্যবসা।
স্থানীয়রা জানান, সেখানে প্রতিদিনই মাদক কেনাবেচা হয়, আর অবৈধ এই মরণ নেশার কারবার ঘিরে প্রায়ই ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। নয়টি ব্লকের এই ক্যাম্পে অন্তত ২০টি স্থানে তিন ধরনের মাদক–গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা–বিক্রি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে এসব মাদক স্পটের নিয়ন্ত্রণেরও হয়েছে হাতবদল। সবশেষ, সোমবার বিকালে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শাহ আলম নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
পরে পুলিশ ফয়সাল ও সেলিম নামে দুজনকে ধারাল দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। যৌথ বাহিনী জেনেভা ক্যাম্পে রাতভর অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে অভিযুক্ত কয়েকজন ‘মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীকে’।
এ বিষয়ে স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানি জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সভাপতি শওকত আলী টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেকে সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত, আবার অনেকে এর সহযোগী।’
তিনি বলেন, ‘এখানে মাদকের কেনাবেচা প্রকাশ্যেই হয়। প্রশাসন যতই চেষ্টা করুক, মাদক ব্যবসা বন্ধ করা যায় না। এই ব্যবসার পেছনে প্রভাবশালী মহল রয়েছে।’

বাসিন্দাদের অভিযোগ, আধিপত্য ও মাদক ব্যবসা নিয়ে সংঘর্ষ লেগেই আছে। গত তিন দিনে ককটেল বিস্ফোরণ ও সহিংসতায় কয়েকজন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন নারীও আছেন।
পুলিশ জানায়, জেনেভা ক্যাম্পের সেক্টর ৭-এর আব্দুস সালামের ছেলে সোহেলের (বুনিয়া সোহেল নামে পরিচিত) বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত ৩০টি মামলা, যার মধ্যে মোহাম্মদপুর থানায় তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া অপহরণ, চাঁদাবাজি ও মাদক সংক্রান্ত মামলাও আছে। ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর র্যাব সোহেলকে সিলেটের কোতোয়ালি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। কয়েক মাস পর জামিনে বের হয়ে তিনি আবার শুরু করেন মাদক ব্যবসা। চলতি বছরের ৪ জুন সেনাবাহিনী ও র্যাব-২ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ফার্মেসি থেকে এক কোটি টাকার বেশি মূল্যের মাদক জব্দ করে।
রোববার সকালে সোহেল ও তার সহযোগী নাদিম (বেজি নাদিম নামে পরিচিত) আরেক মাদক ব্যবসায়ী রাজার (স্থানীয়রা ডাকেন পিচ্চি রাজা) মালিকানাধীন একটি দোকানের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পিচ্চি রাজার বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক হত্যা ও মাদকের মামলা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পের সরু গলিগুলোতে অভিযান চালানো চ্যালেঞ্জিং, তবে মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারের মুখোমুখি আনতে নিয়মিত অভিযান চলছে।’
প্রায় ১৪ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা জেনেভা ক্যাম্পে ৯টি সেক্টরের ৫ হাজার ছোট ঘরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করে। চারটি প্রবেশপথ থাকলেও সেখানে রয়েছে দেড়শ’রও বেশি সরু গলি। বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকে পেশায় সিএনজি চালক, নরসুন্দর, কসাই, দর্জি, রাঁধুনি ও মুদি দোকানদার।
ক্যাম্পজুড়ে অন্তত ২০টি স্থানে বিক্রি হয় গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা। প্রায় দেড় হাজার মানুষ, নারী ও শিশু এই ব্যবসায় জড়িত। বুনিয়া সোহেলের গ্রুপ সেক্টর ৭, ৩ ও ৫-এ সক্রিয়। একই সঙ্গে কামাল বিরিয়ানি, সাইদপুয়া ও ভাইয়া সেলিমের নেতৃত্বাধীন দলও সক্রিয়। বাশির ও চুয়া সেলিমের গ্রুপ সেক্টর ১, ২, ৪, ৬ ও ৮ নিয়ন্ত্রণ করে, যাদের সহায়তা করে ‘বোবা বিরিয়ানি, লাড্ডু কসাই, আনোয়ার, চারকু নূর ইসলাম ও পিচ্চি রাজার’ দল।
ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই নিজ নামের সঙ্গে একটি বাড়তি বিশেষণে ‘ভূষিত’। কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে নামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এসব বিশেষণ এখন তাদের পরিচয়ের অংশ হয়ে গেছে। যেমন পিচ্চি রাজা, বেজি নাদিম, মুটকি সিমা ইত্যাদি।
ক্যাম্পের চেয়ারম্যান, বিএনপির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাসুদ কাদরি বলেন, ‘মূল সমস্যা হলো মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার। একদল বিক্রি করে, আরেকদল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্বে সবসময় সংঘর্ষ হয়।’
বাসিন্দাদের তথ্য মতে, বুনিয়া সোহেলের সহযোগীদের মধ্যে রয়েছেন ‘বেজি নাদিম, টুনটুন, লালা, দাগি রুবেল, ভাতিজা রুবেল, সাগির, এসকে নাসিম, পরী ও তার ভাই আরিফ, মুটকি সিমা এবং চান্দা’।
অন্যদিকে, পিচ্চি রাজা, যিনি ব্লক বি-র ৭৮ নম্বর বাড়ির আবদুল মতলবের ছেলে, তার সহযোগীদের মধ্যে আছেন খোরশেদ, বড় রাজা, আদিল, সাজ্জাত, খান কামরান, সোজন, বিলুম ও ফয়জান।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘বুনিয়া সোহেল ও পিচ্চি রাজা আলাদা গ্রুপের পরিচিত মাদক ব্যবসায়ী। তারা পুলিশের তালিকাভূক্ত আসামি।’
টাইমস অব বাংলাদেশকে তিনি আরও বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশ নিয়মিত নজরদারি চালায়। তবে ঘিঞ্জি এলাকায় অপরাধীরা কৌশলে গলিতে সক্রিয় থাকে।’