মিলমালিকদের দয়ার ওপরেই চালের বাজার

আরেফিন তানজীব
6 Min Read
ফাইল ছবি

দেশে বর্তমানে চালের বাজারে চলছে অস্থিরতা। দুই সপ্তাহ ধরে মিলমালিকরা খুচরা ও পাইকারি বাজারে চালের দাম প্রতি কেজিতে গুণগত মানভেদে তিন থেকে আট টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে সরকারি নজরদারির ঘাটতিতে।

যদিও সরকার দাবি করছে, তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছে যাতে দাম আর না বাড়ে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি নজরদারি বাড়ালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মজুতদারি রোধ করা সম্ভব।

জানা গেছে, যখন কৃষকদের কাছে ধান থাকে, তখন বাজারে চালের দাম কম থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যখন নিয়ন্ত্রণ নেন, তখন দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়। কৃষকদের হাত থেকে ধান চলে যাওয়া পর্যন্ত ধানের দাম কমিয়ে রাখে মিলাররা, এরপর চালের দাম বাড়িয়ে দেয়।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে চালের দাম গড়ে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এক মাসেই ভালো মানের চালের দাম ৫ শতাংশ এবং মাঝারি ও মোটা চালের দাম ৯ শতাংশ বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মিলাররা পাইকারি আড়তে চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট চালের ৫৫ শতাংশই বোরো মৌসুমে উৎপন্ন হয়। ফলন ভালো হলে সরবরাহ বাড়ে এবং বাজারে দামও কমে।

চলতি মৌসুমে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৯৫ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৯৩ লাখ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ কোটি ৫ লাখ টন এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর মূল্য বুলেটিনে বলা হয়েছে, এক মাসে নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, পাজাম ও লতার দাম ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ইরি ও স্বর্ণার দাম ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে।

মাঠ পর্যায়ের তদন্তে আরও বেশি দাম বৃদ্ধির তথ্য মিলেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, চালের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

সরকারের গুদামেও পর্যাপ্ত মজুত আছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারের গুদামে ১৭ লাখ ৬৪ হাজার টন চাল ও গম মজুত ছিল, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ টন বেশি।

ঢাকার খুচরা বাজারে মিনিকেট চাল এখন প্রতি কেজি ৮০–৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ঈদের আগে ছিল ৭২–৭৪ টাকা। ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ এবং পাইজামের মতো মাঝারি চালের দাম প্রতি কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে ৬০–৬৪ টাকা হয়েছে। মোটা চাল স্বর্ণার দাম ২–৪ টাকা বেড়ে ৫৮–৬০ টাকা হয়েছে।

পাইকারি বাজারেও একই চিত্র। ঢাকার কারওয়ান বাজারে ৫০ কেজির মিনিকেট চালের বস্তা এখন ৩৯০০–৪০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ঈদের আগে ছিল ৩৫০০–৩৬০০ টাকা। ব্রি-২৮ ও পাইজাম চালের বস্তা (৫০ কেজি) ৩ হাজার ১০০ টাকায় উঠেছে, যা আগে ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা ঘেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা।

সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও টাউন হল বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদুল আজহার পর চালের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। যদিও বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও মিলমালিকেরা ধান কিনে কৃত্রিমভাবে মজুত করছে, যা খুচরা বাজারে প্রভাব ফেলছে।

একজন বিক্রেতা বলেন, ভালো চালের সঙ্গে মাঝারি ও মোটা চালের দামও বেড়েছে। দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের বাজার বগুড়াতেও দাম বেড়েছে। বগুড়া জেলা চাল মিলমালিক সমিতির সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম বেশি, এজন্য চালের দাম বাড়ছে।’

বড় করপোরেট গ্রুপগুলো হাজার হাজার মণ ধান কিনছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। অথচ সাধারণ মিলমালিকরা ৫০০ মণ কিনলেই সরকারের নজরদারি শুরু হয়, যোগ করেন তিনি।

বাজার বিশ্লেষক ও কৃষি খাতের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বড় করপোরেট ও মিলমালিকরা ধান মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। তারা ঈদের আগে কৃষকদের কাছ থেকে সস্তায় ধান কিনে গুদামে রেখেছে, আর এখন নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়াচ্ছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বড় ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও করপোরেট গ্রুপের কারসাজির কারণে বাজার অস্থির। তিনি মনে করেন, সরকারি পর্যবেক্ষণ বাড়ালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং মজুতদারি রোধ হবে।

কৃষি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে কৃষকদের ফসল রক্ষায় এবার ১৫ দিন আগেই সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় শুরু করেছে সরকার।

তবে তিনি স্বীকার করেন, দুর্নীতি বড় সমস্যা। আর সেটি দূর করতে পারলে অন্য সমস্যাগুলোও সমাধান করা সম্ভব।

সোমবার রাজধানীতে এক খাদ্য নিরাপত্তা সেমিনারে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ফসল তোলার মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে—এমন অভিযোগ পুরোপুরি সঠিক নয়।

তবে তিনি স্বল্পমাত্রায় দাম বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বাজারে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে যাতে দাম আর না বাড়ে।’ কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, সবই মিলারদের কারসাজি।

তিনি বলেন, ‘তারা বাজার অস্থির করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। যখন কৃষকের কাছে ধান থাকে, তখন দাম কমিয়ে কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর কৃষকের ধান শেষ হলে, দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’

সরকারের কাছে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি, যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *