‘মার্কিন দূতাবাস আমার সাথে যোগাযোগ করে’

টাইমস রিপোর্ট
7 Min Read
‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক

 

‘৫ আগস্ট সকাল থেকেই মানুষেরা যার যার মতো করে রাস্তায় নেমে পড়েছিল। সকাল থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ এত বেশি আক্রমণাত্মক ছিল যে অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা দাঁড়াতেই পারেনি’, চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ দিনগুলোর কথা এভাবে স্মৃতিচারণায় বলেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক,  বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক গ্রন্থে অভ্যুত্থানের দিনলিপি তুলে ধরেছেন সজিব ভূঁইয়া। গত মার্চে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিত বইয়ে ‘৩৬ জুলাই’ নামক পর্বে তিনি তুলে ধরেন উত্তাল দিনগুলোর কথা।

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘৫ আগস্ট মুগদায় ইশতিয়াক নূর মুহিতের বাসা থেকে বের হলাম সকাল ৯টার দিকে। আমি, মোয়াজ্জেম আর বাকের সিএনজি নিয়ে বের হলাম। যাত্রাবাড়ীর ভেতরের সড়ক হয়ে পুরান ঢাকায় চানখাঁরপুলের নাজিমুদ্দিন রোডে পৌছাতে পৌছাতে দশটা-সাড়ে দশটা বেজে গেল। আসার পথে নানা জায়গায় গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। আমি, নাহিদ ভাই আর বাকের শাহবাগে, আর সামনের সারির অন্য সমন্বয়কদের ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে থাকার কথা ছিল।’

‘মাহফুজ ভাই ছিলেন শাহবাগের আশপাশে। তিনি তারেক রেজার ফোন থেকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন।’

‘সেদিন সকালে পুরান ঢাকায় এসে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। শহীদ মিনারে সমাবেশে যোগ দিতে আসা দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ লোকের ওপর সকালেই হামলা হয়। ওই এলাকায় আর কেউ ঢুকতে পারেনি। শহীদ মিনারে আহতরা চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেল। চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে লক্ষাধিক লোক আসার পথে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল।’

‘বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে’…জুলাই অভ্যুত্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন অকুতোভয় ছাত্র-জনতা। ছবি: অনিক রহমান/টাইমস

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম বুলেট রুখে দেওয়ার দিনগুলোর প্রসঙ্গে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘চিন্তা করেছিলাম, যাত্রাবাড়ীর ওই জমায়েত এসে চানখাঁরপুল হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকবে। আমরাও তখন ক্যাম্পাসে এসে ঢুকব। আমরা চানখাঁরপুলে যে ভবনটিতে “স্বপ্ন”র আউটলেট তার ছাদে গিয়ে দেখতে পাই, পুলিশ নাজিমুদ্দিন রোডের সোহাগ হোটেলের সামনে এসে মানুষের ওপর গুলি করছে। গুলি করে করে তারা একবার চানখাঁরপুল মোড়ে ফিরে যাচ্ছে। তারপর আবার এগিয়ে এসে গুলি করছে। কারণ, ওই সড়কটা সামান্য বাঁকা হওয়ার কারণে গুলি করার সরাসরি ফায়ারিং লাইন পাওয়া যাচ্ছিল না। সেখানে বিজিবিও গুলি চালাচ্ছিল। আমরা যে ভবনের ছাদে ছিলাম সেটির নিচে ছাত্র-জনতা ছিল।’

‘কংক্রিটে তৈরি ড্রেনের বড় পাইপ সামনে রেখে তার পেছনে মানুষ অবস্থান তাদের কাছে ইট-পাটকেল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমাদের লক্ষ্য করে পুলিশ ছাদের দিকেও গুলি চালায়। আমরা ছাদ থেকে নেমে নিচে যাই। সবাইকে উজ্জীবিত করতে এবং পেছনে থাকা লোকজনকে নিয়ে আসার জন্য বাকের স্লোগান ধরল। আমরা চানখাঁরপুলে পৌঁছানোর আগেই সেখানে বিজিবির গুলিতে দু’জন শহীদ হয়েছিলেন। সেখানে মোট শহীদ হন ৫ জন। রাস্তায় রক্ত লেগে ছিল।’

‘গুলি করে পুলিশ-বিজিবি যখন চানখাঁরপুল মোড়ের দিকে যায়, তখন সবাই একটু বের হয়। আবার যখন গুলি চলে, তখন আবার পাইপের পেছনে গিয়ে লুকায়। গুলি কংক্রিটের পাইপে লাগে। একপর্যায়ে আমিও পাইপের পেছনে চলে যাই। বিজিবি কিছুক্ষণ গুলি করে চলে গেল। কারও গায়ে গুলি লাগেনি অবশ্য। এ সময় খবর পাই, যাত্রাবাড়ী থেকে আসা বিপুল জমায়েতের সঙ্গে আনন্দবাজার এলাকায় পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী থেকে আসা লোকজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছিল। কথা হলো যে আমরা একসঙ্গে পুলিশ-বিজিবির বাধা ভেঙে ক্যাম্পাসে ঢুকব। কিন্তু নাজিমুদ্দিন রোডে সর্বোচ্চ তিন-চার শ লোক ছিল। গুলি ও লাশ দেখে আতঙ্কে কেউ সামনে এগোতে চাইছিল না। বিজিবি গুলি করে চানখাঁরপুলের দিকে চলে যাওয়ার পর সবাই কংক্রিটের পাইপের পেছন থেকে উঠে দাঁড়াল। সবাই আরেকটু এগিয়ে পাইপগুলো ধাক্কা দিয়ে বোরহানুদ্দীন কলেজের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেউ কেউ ইটের টুকরা সংগ্রহ করল। এ সময় হঠাৎ একটা গুলি হলো। আমার ঠিক পাশে দাঁড়ানো একটা ছেলের গায়ে গুলিটা লাগে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো।’

‘দুই ফুট এদিক-ওদিক হলে গুলিটা আমার গায়েই লাগতে পারত। তবে তখন ফায়ারিং লাইনে কেউ ছিল না। আমরা বুঝতে পারলাম না গুলিটা কোত্থেকে এলো। গুলিবিদ্ধ ছেলেটাকে সবাই মিলে ধরাধরি করে ডান দিকের একটা গলিতে নিয়ে গেলাম। আমাদের ধারণা হলো, বার্ন ইউনিটের ছাদ ছাড়া এই গুলি আসা সম্ভব নয়। একমাত্র ফায়ারিং লাইন তখন ছিল বার্ন ইউনিটের ছাদ থেকেই। ছেলেটার শরীরের এক দিক দিয়ে ঢুকে বুলেট অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ছেলেটা ঘটনাস্থলে আমার হাতের ওপরে মারা গেল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। জালিমদের কাছে মানুষের জীবন কত মূল্যহীন!’

‘মনে রোখ চেপে গেল। কয়েক খণ্ড ইটের টুকরা নিয়ে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়ে মারলাম। বাকের বলছিল, বার্ন ইউনিটের ছাদ থেকে স্নাইপার শট হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে নিয়ে পেছনের গলিতে গেলাম। মোয়াজ্জেম সবার জন্য পানি আর রুটি নিয়ে এল। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সেই কর্মকর্তা সে সময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর পরিচিত আশিক নামে একজন ফোন করে বললেন, সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, দেশে সামরিক আইন জারি হবে।’

‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক

‘খবরটা কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে শেয়ার করলাম। ওই সময়টাতে আবার ইন্টারনেট ছিল না। ইন্টারনেট খুলে দেওয়া হয় দুপুর সোয়া ১টার দিকে।’

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের আশপাশে অনেকে জড়ো হয়ে থাকলেও কেউ তখনো ঢুকতে পারেনি। যাত্রাবাড়ীর জমায়েতটা অনেক বড় হওয়ায় তাদের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবি আর পেরে উঠল না। একপর্যায়ে তারা গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। আমি চানখাঁরপুলের “স্বপ্ন” আউটলেটের ভবন থেকে ওয়াই-ফাইয়ে যুক্ত হয়ে ঢাকার অন্যান্য এলাকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। ফেসবুক লাইভে গিয়ে ঘোষণা দিই, কেন্দ্রীয় সমাবেশ শাহবাগে হবে, সবাই শাহবাগে আসুন। আমরা কোনো রকমের সামরিক শাসন মানব না।’

‘কেন্দ্রীয় সমাবেশ থেকে জনতার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হবে। দেশের ভবিষ্যৎ ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, অভ্যুত্থানের মঞ্চ শাহবাগ থেকে নির্ধারিত হবে। সামরিক শাসনের ঘোষণা এলে শাহবাগ থেকে বিকল্প সরকার ঘোষণা করব-এটাই ছিল ভাবনা।’

আসিফ মাহমুদ আরো বলেন, ‘পরে চানখাঁরপুল দিয়ে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যাই। যাত্রাবাড়ীর জমায়েতটা চানখাঁরপুল দিয়ে ঢুকে দোয়েল চত্বর হয়ে শাহবাগের দিকে গেল। সাড়ে ১২টা-১টার দিকে আমরাও শাহবাগের দিকে গেলাম। শাহবাগে পৌঁছে নাহিদ ভাই আর তারিকুল ভাইসহ কয়েকজনকে পেলাম। শাহবাগ তখন জনসমুদ্র। সেখান থেকেই অন্য জায়গার পরিস্থিতির খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। শাহবাগে অনেকক্ষণ স্লোগান দেওয়া হলো। সেখানে একট পিকআপ আর মাইক আসার কথা ছিল। সেগুলো পৌঁছায়নি বলে মিছিল নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *