বর্জ্যে বিপর্যস্ত হাকালুকি হাওর

টাইমস ন্যাশনাল
4 Min Read
বর্জ্য-দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে হাওর। ছবি : টাইমস

হাওরের বুক ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ জেলে রমিজ আলী। হাতে তার পুরোনো জাল। জাল ফেলে টেনে তুলতেই চোখে দেখা যায় হতাশার চিহ্ন। মাছ নয়, জালে উঠে এসেছে পলিথিনের টুকরা, বোতল আর ভাঙা স্যান্ডেল।

হাওরবাসীর কাছে এই জলাধারের গুরুত্ব টের পাওয়া যায় রমিজ আলীর কথায়। দীর্ঘশ্বাস টেনে তিনি বলেন, ‘এই হাওরই আমাদের ভাতের থালা। আগে একবার জাল ফেললে উঠত রূপালি মাছ। আর এখন শুধু প্লাস্টিক।’

এমন হতাশার সুর শোনা যায় মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকি হাওর এবং শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলের আশপাশের অনেকের মুখে, বিশেষ করে যাদের জীবিকার উৎস হাওর। সেই হাওর এখন প্লাস্টিক বর্জ্যে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে।

জেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের হাকালুকি হাওরের মধ্যে বিলের আয়তন ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। হাওরটি মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ী; সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। জুড়ী, ফানাই, সুনাইসহ ১০টি নদী এবং অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া হাওরের সঙ্গে সংযুক্ত।

তবে বর্জ্যে-দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে হাওর। কাগজে কলমে ২৩৮টি বিল থাকলেও প্রায় অর্ধেক বিলের অস্তিত্ব মিলছে না। পলি জমে অনেক বিল ভরাট হয়ে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোও ভরাট হচ্ছে। কয়েক বছর আগে যেসব বিলের নাব্যতা ২০-২৫ ফুট গভীর ছিল, এখন তা কমে নেমেছে ৮-১০ ফুটে।

দূষণের কারণে মাছের বড় প্রজনন কেন্দ্র হাকালুকি হাওরে কমছে মাছের সংখ্যাও। বাইক্কা বিল-হাইল হাওরও দেশের অন্যতম বৃহৎ শস্য ও মৎস্য ভাণ্ডার। কিন্তু সুস্বাদু মাছ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এই দুই হাওরেই মাছের সংখ্যা কমছে দিন দিন। হাওরের পানি ও মাছ গত দশকের তুলনায় কমেছে চারগুণ। তাছাড়া হাওর ভরাটের কারণে অল্প বৃষ্টিতেও সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা।

স্থানীয়রা জানান, হাওর, নদী ও খালে নানা ধরনের অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে অবাধে। এতে করে মনু, ধলাই, জুড়ী নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদী, ছড়া ও হাওর-বিলের জলরাশি দূষিত হচ্ছে। তাতে মাছের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় স্বাদুপানির মাছের বংশবিস্তার কমে যাচ্ছে। কমছে পানির নিচে উৎপাদিত উদ্ভিদও, ফলে হাঁসসহ বিভিন্ন জলজ ও স্থলজ প্রাণীর প্রাকৃতিক খাদ্যের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

জুড়ী উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, বাজারের বর্জ্য ফেলার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। তা ফেলা হচ্ছে জুড়ী নদীতে, সেসব কোনো বাধা ছাড়াই গিয়ে মিশছে হাকালুকি হাওরে।

এখন যে হাওরে আর আগের মতো মাছ মেলে না তা জানান হাওরপাড়ের বাসিন্দারা। পানির নিচ থেকে শুধু প্লাস্টিক উঠে আসে। তাদের কথার সত্যতা মেলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফ হোসেনের কথায়। তিনি জানান, একসময় হাওরে দেশীয় ২৬০ প্রজাতির মাছ ছিল; ২০১৫ সালের জরিপে মাত্র ১৪৩টি প্রজাতি পাওয়া গেছে।

বিচরণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় হাওরে কমছে স্বাদুপানির মাছের বংশবিস্তার। ছবি: টাইমস

 

আগে যে হাওর রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করত সেটাই এখন ডেকে আনছে ধ্বংস। হাওরপাড়ের কৃষক জাকির মিয়া বলেন, ‘আগে হাওর আমাদের ফসল বাঁচাত। এখন হাওরই বন্যা দেয়। অল্প বৃষ্টি হলেই ফসল ভেসে যায়, ঘরে পানি ঢুকে। আমরা বাঁচি কেমনে?’

দীর্ঘদিন ধরে হাওর নিয়ে কাজ করছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মী শাহানা আক্তার। হাওর নিয়ে তার কণ্ঠেও পাওয়া যায় হতাশার আঁচ। তিনি বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় মিঠাপানির হাওর এখন মৃত্যুপথযাত্রী। দ্রুত বিল খনন না করলে, নদী-ছড়া পরিষ্কার না করলে এই হাওর একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।’

হাওরের এমন অবস্থার জন্য সচেতনতার অভাব ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা। তবে মৌলভীবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মাঈদুল ইসলামের দাবি, হাওরের পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

হাওর সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে হাওরে বর্জ্য পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্জ্য ও বালু দিয়ে হাওর ভরাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *