নির্বাচন হলে জামায়াত জিতবে, স্থিতিশীল হবে না: জিএম কাদের

মোশাররফ হোসেন বাবলু
9 Min Read
জিএম কাদের, স্কেচ: টাইমস

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মাদ কাদের এক সাক্ষাৎকারে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফর্মেন্স, আগামি সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচন নিয়ে সংশয়, মব ভায়লেন্স, তার দলের রাজনৈতিক অবস্থান এবং আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলেছেন। জিএম কাদেরের মতে, বিগত শেখ হাসিনার সরকারের পথেই হাঁটছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। তবে তিনি বলেন, ‘তবে পার্থক্য শুধু একটি—শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিলেন, আর এ সরকার মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলে একই বৈষম্য তৈরি করছে।’ তার দাবি, ‘শেখ হাসিনার স্টাইলে নির্বাচন হলে জামায়াতে ইসলামী জয়ী হবে; তবে তারা স্থিতিশীল হবে না।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক শুন্যতায় জামায়াত-শিবিরের উত্থান ঘটেছে।’

রাজধানীর উত্তরার বাসভবনে জাপা চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টাইমস অব বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি মোশাররফ বাবলু

টাইমস: আপনি বলেছেন শেখ হাসিনা সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এমনটি কেন মনে করছেন?

জিএম কাদের: শেখ হাসিনা সরকারের যত খারাপ দিক ছিল, বর্তমান সরকারের মধ্যেও সেসব সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে দলীয়করণ করেছিলেন, নিজের গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিলেন এবং বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিপক্ষকে জেলে দেওয়া, খুন-গুম করা, প্রশাসনকে কুক্ষিগত করা—এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একতরফাভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দখল করে তিনি একক কর্তৃত্ববাদী সরকার কায়েম করেছিলেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ছবি: আব্দুল্লাহ অপু/টাইমস

অন্তর্বর্তী সরকারও একই কাজ করছে। পার্থক্য শুধু একটি—শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিলেন, আর এ সরকার মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলে একই বৈষম্য তৈরি করছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এভাবেই দলীয়করণ করা হচ্ছে।

সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখুন এখানে 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তারা সৎ ও যোগ্য মানুষ। কিন্তু আমাদের অভিভাবক প্রধান উপদেষ্টা যখন কিছু ছাত্রনেতাকে নিজের নিয়োগকর্তা বলে উল্লেখ করলেন, তখনই বোঝা গেল ক্ষমতা অন্যের হাতে চলে গেছে। প্রথমে ছাত্রদের আন্দোলন ছিল কোটাবিরোধী, পরে তা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু যখন নিয়োগকর্তা ছাত্রনেতারা ঘোষণা করলেন, তারা অস্ত্র নিয়ে সরকার পতনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তখন প্রশ্ন ওঠে—তাদেরও তো কেউ অস্ত্র-গোলাবারুদ দিয়েছে, ট্রেনিং দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে।

অতএব, এই সরকার কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নয়। তারা একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করছে। তাদের ওপর যারা আছেন, তারা একটি রাজনৈতিক দলের এবং আন্তর্জাতিক শক্তির মদদপুষ্ট । তারাই দেশের নীতি-নির্ধারণ করছে।

একজন দায়িত্বশীল উপদেষ্টা বলেছেন, ছাত্ররা অস্ত্র ব্যবহার করেছে। আমি নিজেও তাদেরকে একে-৪৭ রাইফেলের ম্যাগাজিন ও গুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখেছি। তারা ‘মব’ সৃষ্টি করছে এবং সেই ‘মব’-কে প্রটেকশন দিচ্ছে। যারা হত্যা করছে তাদের ধরা হচ্ছে না, বরং অন্যদের নামে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দেশে এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।

জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বীর উত্তম ছিলেন। তিনি প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করেছিলেন। বিএনপি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শক্তিশালী দল। তারেক রহমান মেধাবী ও তরুণদের প্রতিনিধিত্বকারী নেতা। আমরা আশা করি আগামী দিনে তাকেই দেশের নেতৃত্বে দেখব।

কিন্তু এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচন কখনো সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, এই সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ছবি: আব্দুল্লাহ অপু/টাইমস

টাইমস: গণঅভ্যুত্থানে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার কি তা পূরণ করতে পারছে?

জিএম কাদের: না, কোনোভাবেই পারছে না। শেখ হাসিনা যা করেছিলেন, এ সরকারও তাই করছে, অনেক সময় আরও বেশি করছে। নির্বাচনের নামে তারা নিজেদের ফর্মুলা প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট লোককে নির্বাচিত করার পরিকল্পনা করছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মতো একই কায়দায় নির্বাচন করতে চাইছে।

টাইমস: আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, আপনারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিলেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?

জিএম কাদের: আমরা কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলাম না, আমরা জনগণের সঙ্গে ছিলাম। জনগণের স্বার্থে যখন প্রয়োজন হয়েছে তখন তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচন আমরা অফিশিয়ালি বর্জন করেছিলাম। ২৭০ জন প্রার্থী কাজই করেননি। তাই আমাদের আওয়ামী লীগের দোসর বলা সঠিক নয়।

টাইমস: বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের কিছু ‘ক্লিন ইমেজ’ নেতাকে নিয়ে আপনারা নির্বাচন করতে চান। তাহলে কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

জিএম কাদের: এটি খুবই স্বাভাবিক। প্রশ্ন করার মতো কিছু নয়। যারা আওয়ামী লীগের হয়ে খারাপ কাজ করেছেন তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু সাধারণ ভোটার বা কর্মী যারা আছেন, তাদের কি ভোটাধিকার কেড়ে নেবেন? নাগরিকত্ব বাতিল করবেন? রাজনীতিতে দলবদল স্বাভাবিক ঘটনা। বিএনপির অনেক নেতা আমাদের দলে যোগ দিয়ে নির্বাচন করেছেন, জামায়াতের নেতারাও যোগ দিয়েছেন। তাই আওয়ামী লীগের যেসব নেতা অপরাধে জড়িত নন, আদালতে দোষী সাব্যস্ত নন, তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ নেই।

টাইমস: এক বছর যেতেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এতে নির্বাচন যথাসময়ে হবে কি না?

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ছবি: আব্দুল্লাহ অপু/টাইমস

জিএম কাদের: আমি আগেই বলেছি, যথাসময়ে নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন হবে। আগে থেকেই ঠিক করা থাকবে কে কোথায় আসন পাবে। এভাবে ফল ঘোষণা করা হবে। কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

টাইমস: ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এটি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি?

জিএম কাদের: অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের দুর্গ মনে করত। ছাত্ররা এই আধিপত্য থেকে মুক্তি চেয়েছে, বিকল্প খুঁজেছে। ছাত্রশিবির সেই সুযোগ নিয়েছে। তারা ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী হলেও কৌশলগতভাবে নিজেদের উপস্থাপন করেছে। তাদের সংগঠন, অর্থ, জনবল—সবই আছে। জাতীয় নির্বাচনে তারা এর সুফল নিতে চাইবে।

টাইমস: অনেকে বলছে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় আসতে পারে। আপনার মূল্যায়ন কী?

জিএম কাদের: শেখ হাসিনার স্টাইলে যদি নির্বাচন হয়, জামায়াত ক্ষমতায় আসতে পারে। জামায়াত আদর্শভিত্তিক দল, তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে। তবে চাইলেই তারা সবকিছু বদলে ফেলতে পারবে না।

টাইমস: ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভাঙা, জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন, রাজবাড়ীর ঘটনা—এসব কীভাবে দেখছেন?

জিএম কাদের: এগুলো নিছক ‘মবোক্রেসি ও সন্ত্রাস’। মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল। গণমাধ্যম, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে। ডিআরইউতে ‘৭১ মঞ্চের’ ঘটনার সময়ও মব ব্যবহার করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে। পুলিশ তাদের রক্ষা না করে উল্টো গ্রেপ্তার করেছে।

আমার বিরুদ্ধেও মব হামলার চেষ্টা হয়েছে। রংপুরে আমার বাসায় হামলার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের অপরাধ শুধু এই যে আমরা এখনো সরকারের লাইনে যাইনি। এ কারণে আমাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চাওয়া হচ্ছে।

টাইমস: জুলাই সনদ ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সমঝোতা হয়নি। আপনার মূল্যায়ন কী?

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ছবি: আব্দুল্লাহ অপু/টাইমস

জিএম কাদের: আমি এটিকে নিষ্ফল মনে করি। দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব নয়। আগে জানতে হবে জনগণের চাহিদা কী।

টাইমস: সবাই নির্বাচন চায়। সরকার বলছে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তারপরও অস্থিরতা কেন?

জিএম কাদের: সরকার যা বলছে, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু বাস্তবে তারা তা দিচ্ছে না। আমি এখানে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারদের কথা বলছি না, তাদের নিয়োগদাতাদের কথা বলছি। তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে, তারাই মূল নিয়ন্ত্রক। তাদের মাধ্যমে নির্বাচন হলে তা টিকবে না। বরং দেশে রক্তক্ষয়, অশান্তি, অস্থিরতা বাড়বে, মানুষ না খেয়ে মারা যাবে।

টাইমস: সম্প্রতি আপনাদের কাকরাইল অফিসের সামনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা হয়েছে। এজন্য আপনাদের দায়ী করা হচ্ছে। কী বলবেন?

জিএম কাদের: এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। মামলা হয়েছে। সবার সামনেই আমাদের অফিসে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এবার পুলিশ অন্তত আমাদের জীবন রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে।

টাইমস: এরশাদের আমলে জাতীয় পার্টিতে বড় বড় নেতা ছিলেন। এখন ভাঙন হয়েছে। তাদের ফিরিয়ে আনার চিন্তা আছে কি?

জিএম কাদের: না, আপাতত কোনো চিন্তা নেই। শুধু জাতীয় পার্টি নয়, সব দলেই ভাঙন হয়েছে। বিএনপিও বহুবার ভেঙেছে। বড় নেতা মানে জনসমর্থন থাকা। আমরা জনগণের সেবার রাজনীতি করছি, সেটাই সঠিক রাজনীতি।

টাইমস: আওয়ামী লীগের বহু নেতা পলাতক। জাতীয় পার্টি এখন ভালো অবস্থানে। আপনাদের শক্তির উৎস কী?

জিএম কাদের: আমাদের শক্তি হলো জনগণ। আমরা জনগণের জন্য কাজ করছি, জনগণই আমাদের আশ্রয় দিচ্ছে। আমি জনগণের ভালোবাসা নিয়েই মরতে চাই। এর বাইরে আর কিছু চাই না।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *