রায়হান রাফির নতুন চলচ্চিত্র তাণ্ডব (২০২৫) দেখা মানে যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি এক টানাপোড়েনের গল্পে জড়িয়ে পড়া। এটি একাধারে জিম্মি সংকটের থ্রিলার, রাজনৈতিক ড্রামা, প্রেম-বিরহের করুণ গাথা, প্রতিশোধের উপাখ্যান এবং মিডিয়াকে নিয়ে করা ব্যঙ্গচিত্রও। এতে সোজাসাপ্টা বয়ান যেন নিষিদ্ধ, এমনকি এটি হতে পারে দর্শক-মাতানো সাহসী অ্যাকশন-মুভিও। কিন্তু গভীরে গেলে স্পষ্ট হয়, এটি এক অনিবার্য সমাজবাস্তবতার বিপরীতে পলায়ন নয়, প্রতিরোধ।
দুর্নীতি, গুম, বেকারত্ব এবং গণমাধ্যমের আপসের দেশে রাফি পলায়নকে শুধু নিস্তার হিসেবেই দেখান না—তিনি সেটিকে রূপ দেন প্রতিবাদে। সিনেমার ঘরানাকেই তিনি ব্যবহার করেন এক প্রজন্মের হাহাকারে, মুক্তি আর ন্যায়বিচারের তৃষ্ণাকে রূপ দেওয়ার গল্পে। সিনেমার কাহিনী গড়ায় একদিকে পলায়নে, আবার ফিরে আসে নতুন তীব্রতায়। ‘তাণ্ডব’ যেন বলতে চায়, এই ব্যবস্থা থেকে বাঁচতে হলে তাকে অতিক্রম করতেই হবে। তা বাস্তবতাকে আঁকড়ে নয়, বরং প্রেম, প্রতিশোধ ও দৃশ্য-আড়ম্বরের মধ্য দিয়ে।
সিনেমার শুরুতেই দর্শক ও চরিত্ররা আটকে পড়েন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল বাংলা’র স্টুডিওতে, যেখানে মুখোশধারী এক সশস্ত্র ব্যক্তি সকলকে জিম্মি করে রাখে। যেন ‘ডগ ডে আফটান নুন’-এর ঢঙে একটি থ্রিলার শুরু হয়, কিন্তু হঠাৎ করেই আমরা ফিরে যাই এক দীর্ঘ বিষণ্ন ফ্ল্যাশব্যাকে—যেখানে দেখা যায় শাকিব খান অভিনীত আবাধ স্বাধীনতা। প্রেম, অপবাদ, এবং পুলিশি নির্যাতনের বিভীষিকা নিয়ে গড়া এই অংশটুকু সিনেমার প্রথম কাঠামোগত পলায়ন।
এখানে স্বাধীন একজন উগ্রবাদী নন—বরং একজন নিষ্পেষিত যুবক, যে সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মের শিকার।
গল্প বারবার ঘরানা বদলায়—প্রেমকাহিনী রূপ নেয় জেলভাঙার থ্রিলারে, প্রতিশোধের গল্প হয় গণমাধ্যমের ট্র্যাজেডি। প্রতিবার আবেগচূড়ান্ত মুহূর্তে সিনেমাটি ভেঙে পড়ে এক নতুন রূপে। এই ভাঙাগড়ার মধ্যেই ধরা পড়ে একটি ট্রমাগ্রস্ত সমাজের মানসিক ভাঙন।
সবচেয়ে আলোচিত ‘লিচুর বাগান’ গানের দৃশ্যটি—এক বলিউডধর্মী নাচগানের সংযোজন, যেখানে সবচেয়ে দুঃখঘন মুহূর্তে আমরা হঠাৎ নাচতে থাকি। এটি অযৌক্তিক মনে হলেও, চলচ্চিত্রের তীব্র বাস্তবতায় এটি হয়ে ওঠে এক অস্ত্র—পলায়ন নয়, প্রকাশ। এই নাচের মধ্য দিয়েই যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়, কষ্ট ভুলে নয়, বরং কষ্ট নিয়েই আমরা নাচি।
শুধু দৃশ্য নয়, তাণ্ডবের সংলাপ, অ্যাকশন এমনকি ধীরগতি গুলির ব্যবহারও একধরনের আবেগ-নাট্য। শাকিব খানের নির্বাক প্রতিশোধ যেন হয়ে ওঠে এক লাইভ পারফরম্যান্স। বাস্তবতার দাবিতে নয়, বরং এক গ্রীক ট্র্যাজেডির মতো, এক শেক্সপিয়ারিয় প্রতিশোধের নাট্যমঞ্চ।
শেষে যখন জানা যায়, স্বাধীন আসলে স্বাধীন নয়—বরং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিখাইল, এক পালাতক সন্ত্রাসী, যিনি স্বাধীনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তার পরিচয় ধারণ করেছেন—তখন ব্যক্তিগত বেদনা রূপ নেয় জাতিগত প্রতিশোধে। মিখাইল তখন কেবল ব্যক্তি নয়—এক প্রতীক, এক প্রেতাত্মা, এক ব্যতিক্রমী নায়ক। যেখানে বিচারব্যবস্থা ব্যর্থ, সেখানে ন্যায় ফিরে আসে মৃতের ছদ্মবেশে।
মিখাইলের বিপরীতে জয়া আহসানের ‘সায়রা’ চরিত্রের মেয়েটি সাংবাদিকতা পেশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এক নিরব বিদ্রোহ। তিনি তার পেশার আদর্শ ত্যাগ করেন যখন নিজের ভাই গুম হয়, আর মিডিয়া মুখ ফিরিয়ে রাখে। রাফি একে উপস্থাপন করেন দুর্বলতা নয়, বরং সাহসিকতা হিসেবে। একটি গণমাধ্যম যখন ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ব্যর্থ, তখন নিউজ রুম উড়িয়ে দেওয়াই হয়তো একমাত্র নৈতিক পদক্ষেপ।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ‘তাণ্ডব’ যেন এক ছেঁড়া ফাটল। এটি মুখে মুখে ঘোরে এমন বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে—গুম, পুলিশি নির্যাতন, মিডিয়ার সমঝোতা—একটি বাণিজ্যিক ভাষ্য নির্মাণ করে। শেষ দৃশ্যগুলো যেন বিপ্লবী স্বপ্ন; একটি লাইভ-উত্থান, অভিজাত শ্রেণির পতন এবং এক সম্ভাব্য সিনেমাটিক জগতের আভাস– যেখানে থাকে ধারাবাহিক ন্যায়বিচার।
‘তাণ্ডবের’ সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত এখানেই—রাফি সিনেমাটিকে পরিণতির ঘোরে থামান না, বরং তিনি দেন এক অসম্ভব আশাবাদ। এমন এক আশা, যা বলে, ‘বাস্তবতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক হবে না, তাকে ভাঙতে হবে—পুনর্গঠন করতে হবে।’
‘তাণ্ডব’ নিখুঁত নয়। তার চিত্রনাট্য অনেকসময় ভাড়ি, কিছু দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে। কিন্তু এর সব খুঁত সেই নির্মাতার, যিনি নিরাপদ খেলেন না— আগুন ধরাতে চান।
এই আগুনেই রাফি তৈরি করেন সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র—যা সাহস করে স্বপ্ন দেখে, এবং সিনেমার ভাষায় বলে, ‘পলায়ন মানেই পরাজয় নয়। অনেক সময়, সেটিই বিপ্লবের প্রথম ধাপ!’