অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক সতর্কবার্তা উপেক্ষা করায় গোপালগঞ্জে রক্তক্ষয়ী সহিংসতা ও প্রাণহানী হয়েছে বলে জানা গেছে।
টাইমস অব বাংলাদেশ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নথি যাচাই করে দেখেছে, সেসব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার ও এনসিপির ‘সতর্কবার্তা উপেক্ষা’ করায় গোপালগঞ্জে সংহিসতায় ৫ জন নিহত ও কয়েক ডজন আহত হন এবং সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, বহুবার সতর্ক করা সত্ত্বেও এনসিপি ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ পালন করতে গেলে ‘আওয়ামী লীগের ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত ওই অঞ্চল পরিনত হয় রণক্ষেত্রে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘জেলা পুলিশ একাধিক শীর্ষস্থানীয় এনসিপি নেতাকে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে আগেই অবগত করেছিল। কিন্তু নেতারা সে সতর্কতা আমলে নেননি।’
১৬ জুলাই সহিংসতার দিনে সকাল ১০টায় শুরু হতে যাওয়া সমাবেশের আগেও স্থানীয় প্রশাসন এনসিপি নেতাদের আবারও সতর্ক করে। নেতাদের সার্কিট হাউসে দুপুর পর্যন্ত ‘আটকে রাখা’ হয়। এ সময় একটি পুলিশ ভ্যান পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়—এনসিপি কর্মসূচি এগিয়ে নিলে বড় ধরনের হামলার আশঙ্কার এটি ছিল স্পষ্ট ইঙ্গিত।
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও, এনসিপি নেতারা সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে সমাবেশ স্থলের দিকে অগ্রসর হন। অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে হামলা শুরু হয়, এবং তা পরিণত হয় সহিংস সংঘর্ষে।
গোয়েন্দা দলিলপত্র ও বিভিন্ন সংস্থার অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, এমনকি ওই সহিংসতার ঘণ্টাখানেক আগেও যথাযথ ব্যবস্থা নিলে হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল।
টাইমস অব বাংলাদেশ বিশেষ শাখার (এসবি), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখেছে, এসব নথিতে এনসিপির ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির অন্তত ১০ দিন আগে ‘সুনির্দিষ্ট সংঘাতের সতর্কবার্তা’ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো এসব প্রতিবেদনে এনসিপির মিছিলের গতিপথে তিনটি নির্দিষ্ট স্পর্শকাতর পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়— কোটালীপাড়ার প্রবেশপথ, জেলা পুলিশ লাইন্সের আশপাশ এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
সংস্থাগুলো আগাম সতর্কবার্তায় জানায়, ‘কাজুলিয়া, কাটি ও মাঝিগাটি এলাকায় উশৃঙ্খল জনতা জড়ো হয়ে সহিংসতা করতে পারে।’
গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নারী ও শিশুদের সামনে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটানো হতে পারে— যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় এবং এ দৃশ্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার’ এর দুরভিসন্ধিও থাকতে পারে।
তবুও এনসিপি নেতৃত্ব পূর্ব পরিকল্পিত কর্মসূচি বাতিল না করে চালিয়ে যান। গোয়েন্দা মূল্যায়নে আরও বলা হয়, ‘দলের কিছু কট্টরপন্থী নেতা সরাসরি উত্তেজনা বাড়াতে ভূমিকা রাখেন।’
এনসিপির কর্মসূচির একদিন আগে ১৫ জুলাই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়—যা আরও অস্থিরতা তৈরি করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৬ জুলাই এক জরুরি বৈঠকে বসে— যেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপরেও উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে, সরকার কেবল নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি জোরদার করেই এনসিপিকে কর্মসূচি পালনে অনুমতি দেয়।
এছাড়া স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া— ঢাকায় একটি বিশেষ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সিসিটিভিতে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
এদিকে বিএনপি মনে করছে, এই সহিংসতা ছিল আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচালের এক পরিকল্পিত কৌশল।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট শক্তির এক প্রদর্শনী— যার উদ্দেশ্য ছিল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসুদ ইমরান মান্নু মনে করেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকারের নামে এটি একটি পরিকল্পিত সংঘাত।’
তিনি বলেন, ‘এটি ছিল প্রতিবাদের নামে উস্কানি। এর লক্ষ্য ছিল স্থিতিশীলতা ধ্বংস করা, যা কোনো সমাধান নয়।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) সরওয়ার হোসেন বলেন, ‘গোপালগঞ্জের ঘটনা শাসনব্যবস্থার বড় ব্যর্থতার প্রকাশ। তবে আক্রান্ত নেতাদের উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও বিজিবি পেশাদারিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে সহিংস পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়।’
‘গোয়েন্দা তথ্য জানা সত্ত্বেও প্রশাসন ও পুলিশ নির্লিপ্ত থেকেছে— যা চরম অবহেলার প্রমাণ। এটি গভীরভাবে উদ্বেগজনক এবং এখনই এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার উচিত’, যোগ করেন তিনি।
তবে এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী তাদের ওইদিনের কর্মসূচির সমর্থনে টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা অনুমোদন পাওয়ার পর আমরা গোপালগঞ্জে আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একজন সিনিয়র নেতা অনিক রায় সারা দেশে আমাদের মার্চ কর্মসূচি সংগঠিত করার দায়িত্বে ছিলেন। তিনিই নিরাপত্তা অনুমতির তথ্য আমাদের জানান, যার ভিত্তিতে আমরা গোপালগঞ্জে কর্মসূচি চালিয়ে যাই।’
ওই সংঘাতের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার সহিংসতার আশঙ্কা করেছিল, তবে এর মাত্রা প্রত্যাশিত ছিল না।’
দৃশ্যত, ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত এনসিপি দেশজুড়ে চলমান ‘জুলাই পদযাত্রায়’ যে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও ভিআইপি নিরাপত্তা পাচ্ছে, তা এরই মধ্যে রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজে সৃষ্টি করেছে তীব্র সমালোচনা।