ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া তানিম নূরের চলচ্চিত্র ‘উৎসব’ সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা যোগ করেছে। অ্যাকশন-নির্ভর ঈদের ধারার বাইরে গিয়ে ডোপ প্রোডাকশন চরকি আর লাফিং এলিফ্যান্ট প্রযোজিত এই ছবি পারিবারিক কমেডি-ড্রামার মাধ্যমে ঈদের আনন্দময়তাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে।
মূলত এটি চার্লস ডিকেন্সের ‘এ ক্রিসমাস ক্যারল’ (A Christmas Carol) উপন্যাসের একধরনের বাংলাদেশি সংস্করণ । তবে কোন হুবহু অনুবাদ নয়—নূর ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় এই গল্পটিকে পুনর্গঠন করেছেন, যেখানে রিডেমশন (redemption) বা আত্মশুদ্ধির ধারণা কেবল রয়ে যায় না, বরং ঈদের মতো এক আত্মিক উৎসবের মধ্য দিয়ে আরও গভীরতর মানবিক ব্যাখ্যা পায়।

ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহাঙ্গীর (জাহিদ হাসান)—মোহাম্মদপুরে থাকা এক আত্মকেন্দ্রিক ও নির্লিপ্ত মধ্যবয়সী মানুষ, যাকে সবাই ‘খাইস্টা’ বলে ডাকে। তার চরিত্রের মধ্য দিয়েই পরিচালক তুলে ধরেছেন ব্যক্তি পরিবর্তন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ঈদের আত্মিক ভার।
ডিকেন্সের মতোই এখানে তিনজন ‘অতিথি’ আসে—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্মৃতি ও সম্ভাবনা নিয়ে। তবে এখানেই আসে চমক: অতীতের স্মৃতি উঠে আসে ‘মধুমিতা হলে তার জীবনচিত্রের প্রদর্শনী’ হিসেবে—এক অভিনব সিনেমার ভেতর সিনেমার কৌশল। এতে একদিকে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে স্মৃতি সংরক্ষণের মাধ্যম, আবার সমাজ ও আত্মপর্যালোচনারও প্রতিফলন।
ছবির এক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ—‘জীবনের ছবিতে আসলে প্রধান চরিত্র বলে কিছু নেই’—সমকালীন ঢাকা শহরের বাড়তে থাকা আত্মকেন্দ্রিকতা আর ভেঙে পড়া সামাজিক বন্ধনকে তীব্রভাবে প্রশ্ন করে। ঈদকে এখানে শুধুই রীতির নয়, বরং সহমর্মিতা ও একতার উৎসব হিসেবে দেখানো হয়েছে। ভ্রাতৃত্বের পুরনো রেওয়াজ—দরজায় দরজায় খাওয়া দাওয়ার আমন্ত্রণ—আবারও আবেগ জাগিয়ে তোলে।
ছবির এক অনন্য দিক হলো একটি উর্দুভাষী বিহারী বিরিয়ানির বাবুর্চির সংযোজন। এটি একদিকে ঢাকার বহুজাতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যায়, অন্যদিকে এক নিঃশব্দ সহাবস্থানের বার্তা দেয়।
চিত্রনাট্যটি তিনটি ভাগে বিভক্ত হলেও বর্ণনাশৈলী পুরোপুরি লিনিয়ার নয়। সিনেমার মধ্যে সিনেমা বা অতীত দেখানোর উপায়টিকে স্মৃতিচারণার রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
জয়া আহসানের একটি সংলাপ—‘শেষ কবে হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছেন?’—শুধুই সংলাপ নয়, বরং থিয়েটারবিমুখ দর্শকদের একধরনের আত্মসমালোচনার খোঁচা। এই রকম আত্মসচেতনতা পুরো ছবিতেই ছড়িয়ে আছে।
জাহিদ হাসানের অভিনয় শুরুর দিকে হালকা মনে হলেও ধীরে ধীরে এক গভীর বিষণ্ণতায় রূপ নেয়—যা একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। চঞ্চল চৌধুরী (অতীত), জয়া আহসান (বর্তমান), ও অপি করিম (জীবনের সংগ্রাম)—এই তিন ভূতের ভূমিকায় থাকা জনপ্রিয় তারকারা নিজেদের উপস্থিতি দিয়েই চরিত্রগুলিকে আরো গভীরতা দিয়েছেন। চঞ্চলের ‘আমি তো সবখানেই আছি’ বা অপির দীর্ঘ অনুপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত একধরনের মজার আত্মউপলব্ধি তৈরি করে।

তরুণদের মধ্যে সাদিয়া আয়মান ও সৌম্য জ্যোতির রসায়ন ছবি জুড়ে একধরনের নতুনত্ব আনে, যা প্রজন্মগত গল্প বলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পরিচালক হিসেবে তানিম নূরের কাজ খুবই সুসংহত। হাস্যরস, আতঙ্ক ও আবেগ—তিনটি মাত্রাকে একই ছবিতে সফলভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। সংলাপগুলোতে স্থানীয় উপমা, সাহিত্যিক ইঙ্গিত ও পুরোনো নাটকের (যেমন ‘আজ রবিবার’) প্রতি রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যায়, যা সিনে-দর্শকদের স্মৃতিকাতর করে।
রাশেদ জামানের চিত্রগ্রহণ ছবিটিকে কখনো চরিত্রের মনোজাগতিক দর্শনের কাছাকাছি আবার কখনো বা কাব্যিক করে তোলে। ঢাকার জনবহুলতা আর ব্যক্তিগত নির্জনতাকে একই ফ্রেমে ফুটিয়ে তোলা এই সিনেমাটিকে অনন্য করে তোলে।
জাহিদ নিরবের সঙ্গীত পরিচালনা ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানের ভিন্ন সংস্করণ সাহসী ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনায় পূর্ণ। আর্টসেলের ‘ধূসর সময়’ ও লেভেল ফাইভের ‘তুমি’ সংযোজন করে প্রজন্ম-ব্যাপী আবেগের সেতুবন্ধন।
শৈব তালুকদারের শব্দ-পরিকল্পনা ছবির আবহ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রতিটি ফোলি সাউন্ড, পরিবেশের শব্দ ও সংগীত—সবকিছু মিলে দর্শককে শুধু দৃশ্য নয়, অনুভবের জগতে নিয়ে যায়।
ছবির ট্যাগলাইন—‘পরিবার ছাড়া এই সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ’—হাস্যরসাত্মক হলেও এর মধ্যে রয়েছে আত্মবিশ্লেষণের এক গভীর আহ্বান। ঈদের সময় যেখানে অন্যান্য বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও ‘উৎসব’ নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
এই ছবি কেবল ভুতুড়ে নয়, বরং আত্ম-অন্বেষণ, ভুলে যাওয়া নিজেকে ফিরে পাওয়ার গল্প। ঈদের সিনেমা আবার হতে পারে আত্মীয়তা, সংস্কৃতি আর পরিপূর্ণ গল্প বলার একটি মাধ্যম—এই বার্তাই দিয়ে গেল উৎসব।
পরিচালনা ও প্রযোজনা: তানিম নূর | চিত্রগ্রহণ: রাশেদ জামান | চিত্রনাট্য: আয়মান আসিব স্বাধীন, সামিউল ভূঁইয়া | অভিনয়: জাহিদ হাসান, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, অপি করিম, আফসানা মিমি, তারিক আনাম খান, সাদিয়া আয়মান, সৌম্য জ্যোতি, আজাদ আবুল কালাম, সুনেরাহ বিনতে কামাল প্রমুখ।