ভারী বৃষ্টিপাত ও ঢলের পানিতে দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। ইতিমধ্যে বন্যায় আক্রান্ত ২১ জেলা। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জনপদের পাশাপাশি ডুবছে কৃষিজমি। এতে বিস্তর ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। প্রাথমিক তথ্যে দেশের ৭২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি সরাসরি ক্ষতির শিকার বলে জানা গেছে। বেসরকারিভাবে পাওয়া তথ্যমতে, বন্যার প্রভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। টাইমস অব বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে প্রতিবেদন।
ফেনী: সদর এলাকায় বৃষ্টি ও নদীর পানি কমলেও প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। তবে পরশুরাম ও ফুলগাজীর বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। নতুন করে তলিয়ে গেছে ফেনী সদর ও ছাগলনাইয়া উপজেলার অর্ধ শতাধিকের বেশি গ্রাম। দুর্গত এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। যান চলাচলে ঘটছে ব্যাঘাত। ধারণা করা হচ্ছে জেলার অন্তত তিন লাখ মানুষ বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফেনী-ফুলগাজী ও ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ছোট আকারের যানবাহন চলাচল বন্ধ। জেলার ৮২টি আশ্রয়কেন্দ্রে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৯ হাজার ২০০ বাসিন্দা অবস্থান করছেন। গতকাল রাত পর্যন্ত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যাকবলিত এলাকা থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থসহ ১৮ জনকে সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা উদ্ধার করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত সোমবার থেকে ভারী বর্ষণের কারণে শুক্রবার পর্যন্ত ফেনীর তিন নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে যায়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ফেনী-ছাগলনাইয়া সড়কের রেজুমিয়া থেকে পৌরসভা পর্যন্ত অংশে এক থেকে দুই ফুট ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। এতে করে নতুনভাবে ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠান নগর, রাধা নগর, শুভপুর ও ছাগলনাইয়া পৌরসভার অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিগুলো ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঢুকে পড়ছে। বৃহস্পতিবার রাতে পর্যন্ত বাঁধভাঙা পানি ঢুকে ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ, মোটবী, ছনুয়া, ফাজিলপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রাম নতুনভাবে প্লাবিত করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘মুহুরি নদীর পানি ১ দশমিক ৯৩ মিটার বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফুলগাজী এলাকার বন্যা কবলিত গ্রামগুলোতে পানির অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। পানির চাপ কমে যাওয়ায় নতুন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা নেই। ’
জেলার ১হাজার ৬শ ৫৫ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল (আউশ, আমন, শাকসবজি, মরিচ) পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
নোয়াখালী: জেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। সূর্যের দেখা মিললেও কমছে না পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নোয়াখালীর নিচু এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়ক, ফসলি জমি, ঘরবাড়ি—সবকিছুই পানির নিচে। অনেক পরিবার তাদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে জেলার, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, সদর ও সুবর্ণচর উপজেলার ৫৩ টি ইউনিয়নের ৪৮০টি পরিবারের দু’লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
জেলার বিভিন্ন জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে পানি নিষ্কাশনের জন্য বিভিন্ন খাল গুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় খালে যে বাঁধ রয়েছে সে বাঁধ গুলো কেটে দেয়া হচ্ছে।
সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ জানান, টানা প্রবল বৃষ্টিতে কৃষিতে বেশিরভাগ বীজ তলা ও সবজি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে । জেলার ৭হাজার ৮শ০৬ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
সাতক্ষীরা: গত এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডসহ সাতক্ষীরা সদর, তালা, কলারোয়া, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে করে আমন বীজতলা, আউশ ধান, সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মৎস্য ঘের। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেননি মৎস্য ও কৃষি বিভাগ। দুর্ভোগে জেলার অন্তত এক লাখ মানুষ।
শরীয়তপুর: জাজিরা উপজেলার পদ্মাসেতু কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের সংলগ্ন মঙ্গলমাঝির ঘাট এলাকায় ডানতীরে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রবল বর্ষণ ও পদ্মা নদীর তীব্র স্রোতের ফলে ধস নেমে গত সোমবার থেকে প্রায় ৫০০ মিটার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ভাঙনে অন্তত ২৫টি দোকান ১০/১৫টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
মাদারীপুর: জেলার শিবচরের আড়িয়াল খাঁ নদের উপর নির্মিত ‘লিটন চৌধুরী’ সেতুর নদী শাসন বাঁধ না থাকায় বর্ষার শুরুতেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেতুর খুব কাছেই নদের পাড়ে ভাঙন শুরু হওয়ায় উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। সেতুর কাছে নদের পাড় ঘেঁষে সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণিস্রোত। ফলে সেতুর কাছেই নদের পাড়ের বেশকিছু জায়গা ভেঙে গেছে।
কক্সবাজার: বৃষ্টি থামায় নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। সদর উপজেলার কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকলেও পাঁচ উপজেলার শতাধিক গ্রাম থেকে পানি নামছে বলে জানা গেছে। প্রশাসন থেকে কিছু এলাকায় শুকনা খাবার পৌঁছালেও পানির কারণে অনেক বাড়িতেই চুলা জ্বলেনি।
কুমিল্লা: টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে কয়েকদিন গোমতী নদীর পানি বাড়লেও শুক্রবার থেকে কমতে শুরু করেছে। এতে স্বস্তি ফিরছে কুমিল্লার গোমতী পাড়ের নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের মানুষদের মাঝে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শুক্রবার সকাল ৯টা ৯ মিনিটে গোমতী নদীর পানি লেভেল ছিল ৮ দশমিক ৯৪ মিটার, যা বিপদসীমার ২ দশমিক ৩৬ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে বৃহস্পতিবার গোমতী নদীর পানি বিপদসীমার প্রায় ছুঁইছুঁই করছিলো। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বৃষ্টিপাত কমায় উজান থেকে ঢলের প্রবাহও হ্রাস পেয়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালীউজ্জামান বলেন, ‘বিপদসীমার অনেক নিচে গোমতীর পানি রয়েছে। তবে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।’
কুমিল্লা জেলার ১১,৫৯০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত বলে জানা গেছে।
বন্যায় ২১ জেলার ৭২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে ডুবে আছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে দেশের ২১ টি জেলার ৭২হাজার৭৬ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল প্রাথমিকভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
এর মধ্যে পানিতে ডুবে আছে আউশ ধানের ৪৪হাজার৬শ৬২ হেক্টর, আমন বীজতলার ১৪হাজার৩শ৯৩ হেক্টর, পাট ১শ৩৫ হেক্টর ও শাকসবজির ৯হাজার৬শ৭৩ হেক্টর জমি। এছাড়াও কলা ১১৪ হেক্টর, পেঁপে ২৯৩ হেক্টর, পান ৩৮৭ হেক্টর, বোনা আমন আবাদ ২৯৭ হেক্টর, মরিচ ১০৪ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন তরমুজ ২৮১ হেক্টর কৃষিজমি প্রাথমিকভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।