হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্য জগতে এক অনন্য নক্ষত্রের নাম। শুধু কথাসাহিত্য নয়, চলচ্চিত্র, নাটক, গান কোথায় তিনি অবদান রাখেননি। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। যুগ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তার অনুপস্থিতি যেন এখনো বাস্তব হয়ে ওঠেনি–এতটাই গভীর তার প্রভাব, এতটাই বর্ণময় তার সৃষ্টি।
সত্তরের দশক যখন ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হল পাঠক-বোদ্ধামহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এরপর তো একে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘দেয়াল’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘বাদশাহ নামদার’ ইত্যাদি উপন্যাস, গল্প দিয়ে। এসবে তিনি তুলে এনেছেন শহর ও গ্রামবাংলার প্রাণ, মানুষের মনের কথা। তার সৃষ্ট চরিত্র হিমু, মিসির আলি, শুভ্র-এদের নিয়ে এক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, ভালোবেসেছে, চিন্তা করতে শিখেছে।
১৯৯০’র দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণযুগে হুমায়ূন আহমেদ এনেছিলেন নাটকে নতুন ধারা। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’–এসব শুধু নাটক ছিলো না, ছিলো সমাজের আয়না। ‘বাকের ভাই’-এর যখন ফাঁসি হয় ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে তখন দেশের মানুষ যেমন কেঁদেছিলেন। মিছিল হয়েছিল তার ফাঁসি বন্ধে। এমন ঘটনা দেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে ওই একবারই ঘটেছে।
শুধু বাকের ভাই নয়, নাটকে তিনি সৃষ্টি করেছেন ওরা তিন জন, তৈয়বের মত চরিত্র। অতি সহজ-সরল সংলাপ, সুক্ষ্ম কৌতুকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সমাজের নানান অসংগতি।
চলচ্চিত্র পরিচালনায় হুমায়ূনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে। পরবর্তীতে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’— সবগুলো ছবিই নিজস্ব ভাষা, নির্মাণশৈলী ও সংবেদনশীলতার অনন্য নিদর্শন। এ ছবিগুলোর জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মানে ভূষিত হন।
ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে ২০১২ এর আজকের দিনে নিউ ইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তবে তার এ মৃত্যু যেন শুধুই দেহত্যাগ। কারণ, হুমায়ূন আহমেদ রয়ে গেছেন প্রতিটি ভক্তের বুকের ভেতরে, হিমুর হলুদ পাঞ্জাবিতে, মিসির আলির যুক্তিবাদে, শ্রাবণের গান আর ভালোবাসার বৃষ্টিতে।
তিনি যেমন বলেছিলেন, ‘মৃত্যু মানে দুঃখজনকভাবে হিমুদের সংখ্যা কমে যাওয়া।’ আজ আমরা আবার তা অনুভব করি।