রাষ্ট্রীয় বিব্রতবোধ ব্যবস্থাপনা নীতি ২০২৫ এর খসড়া

টাইমস রম্য
4 Min Read
নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তারকে ‘বিব্রতকর’ বলেছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা; স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত। গ্রাফিক্স: এআই/টাইমস
Highlights
  • বাস্তবের সঙ্গে অনেক মিল থাকলেও এটি মূলত একটি রম্য রচনা

কিছু শব্দ আছে যেগুলো অভিধানে যা-ই লেখা থাকুক, বাস্তবে মানে একেবারেই ভিন্ন। ‘বিব্রত’ তেমনই এক শব্দ। এর আক্ষরিক মানে সংকোচ, অপ্রস্তুতি বা অস্বস্তি। কিন্তু রাষ্ট্রিক বাস্তবতায় ‘বিব্রত’ শব্দটি এক ধরনের সুরক্ষাকবচ—যার আড়ালে লুকিয়ে ফেলা যায় অস্বস্তিকর দায়, টেবিলের নিচে চালিয়ে দেওয়া যায় এক কেজি সত্য।

সর্বশেষ এই শব্দটি ফিরেছে নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়।

উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এটা একটা বিব্রতকর ঘটনা হয়ে থাকলো আমাদের জন্য।’ জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বললেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত। অর্থাৎ উপদেষ্টা পরিষদে কেউ ‘বিব্রত’, কেউ ‘বিব্রত’ নন।

পরে অবশ্য বোঝা গেল যে, কেউই ‘বিব্রত’ না। যে ফারুকী ‘বিব্রত’ হয়েছিলেন, কোনো কারণে তার ‘বিব্রত’ভাব কেটে গেছে। তাই ফেসবুক থেকে তিনি ‘বিব্রত’ হওয়ার বিষয়টি মুছে দিয়েছেন।

ফারুকী ‘বিব্রত’ হয়ে পরে ‘বিব্রত’ না থাকলেও ‘বিব্রত’ হওয়ার এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আছে আমাদের। যেমন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় হাইকোর্টের একের পর এক বিচারপতি বলেন, ‘আমি বিব্রত, শুনতে পারছি না (হিয়ারিং করতে পারছি না)।’ তখন আওয়ামী লীগ প্রতিবাদে লাঠি মিছিল করেছিল—প্রতীকী সেই মিছিল মনে করিয়ে দেয়, ‘বিব্রত’ হওয়ার বিপক্ষে লাঠি হাতে তুলে নিতে কেউ কেউ ‘বিব্রত’ ছিলেন না।

এরপর তো এই শব্দটি একপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যায়।

২০০৯ সালে খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বিতর্কে বিচারপতিরা ‘বিব্রত’ হলেন। ২০১৭ সালে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান-এর জামিন শুনানিতে বিচারপতি বললেন, ‘বিব্রত’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় একাধিক বিচারপতি এই শব্দ দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। এমনকি কোনো কোনো শুনানিতে আদালতে উপস্থিত না হয়েই ফাইলে লিখে দেন—’বিব্রত, শুনতে পারছি না।’ যেন বিব্রতবোধই নতুন এক বিচারদর্শন।

রাজনীতিতে এই শব্দটি আরো অলঙ্কারময়।

২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন মন্ত্রীরা বলেছিলেন, ‘এটা দুঃখজনক ও বিব্রতকর।’ পরে অবশ্য দেখা গেল, সেই ‘বিব্রত’বোধ খুব স্থায়ী কিছু নয়।

২০২১ সালে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ফাঁস হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বললেন, ‘আমরা ব্যক্তিগতভাবে বিব্রত।’ কেউ অবশ্য পদত্যাগ চাইলেন না। যেমন চিকিৎসক যদি বলেন, ‘রোগীর পচন দেখে আমি বিব্রত,’ কিন্তু ওষুধ না দেন—ঠিক তেমন।

আর বিব্রত শব্দটি আন্তর্জাতিক মানেও উত্তীর্ণ হয়েছে বহুবার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন মনিকা লিউইনস্কি কাণ্ডে বলেছিলেন, ‘আমি বিব্রত।’ এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইমপিচমেন্টের মুখে পড়েন। প্রিন্স অ্যান্ড্রু যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ‘বিব্রত’ হয়ে বাকিংহাম প্যালেস ছাড়েন।

অথচ আমাদের এখানে কেউ যদি বলেন ‘বিব্রত’, আমরা বুঝে নিই—সব ঠিক আছে, শুধু কিছু বলতে চাচ্ছেন না।

‘বিব্রত’ এখন যেন এক ধরনের মৌন সংলাপ। কেউ কিছু না বলেই সব বলে দেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র বলে, ‘আমি জড়িত নই, কিন্তু সব জানি।’ আদালত বলে, ‘আমি নিরপেক্ষ, আরেকজন শুনুক।’ রাজনীতিক বলেন, ‘আমি দায় নিচ্ছি না, বোঝাও কী বোঝার।’

এবং জাতি? জাতি আসলে ‘বিব্রত’ হওয়ার অধিকারটাই হারিয়ে ফেলেছে। কারণ প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ এমন কিছু করে ফেলে, যাতে আমরা ‘বিব্রত’ হয়েই পড়ে থাকি।

তাই হয়তো এখন দরকার একটি নীতিমালা: ‘রাষ্ট্রীয় বিব্রতবোধ ব্যবস্থাপনা নীতি-২০২৫’—যেখানে উল্লেখ থাকবে, কারা কবে কী বিষয়ে ‘বিব্রত’ হতে পারবেন, এবং সেই ‘বিব্রত’বোধ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ প্রত্যাশিত।

তা না হলে ‘বিব্রত’ জাতির ‘বিব্রত’ রাষ্ট্রে আমরা কেবল শব্দ দিয়ে বাস্তবতা ঢাকতে থাকব। এবং সেই শব্দের নাম—‘বিব্রত’। বড় নিরীহ শব্দ, বড় তীক্ষ্ণ অস্ত্র।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *