‘রাজসাক্ষী’ মামুনের ইতিবৃত্ত

কামরুজ্জামান খান
5 Min Read
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ‘রাজসাক্ষী’ হয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন পুলিশের ৩১তম মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জনমনে প্রশ্ন- কে এই আব্দুল্লাহ আল মামুন?

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ের পুলিশ প্রধান ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। বিতর্কিত নির্বাচনে সক্রিয় অবস্থান, জুলাই আন্দোলন দমাতে পুলিশের কঠোর ও নৃশংস তৎপরতায় নেতৃত্বদানসহ নানাভাবে আলোচনায় ছিলেন তিনি।

ইতোমধ্যে মামুনের নামে ১৫৫টি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর কয়েক দফায় তিনি ৬০ দিনের বেশি রিমান্ডে ছিলেন। তবে নিজ অপরাধের বিষয়ে তিনি দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেননি। অবশেষে বৃহস্পতিবার তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্বেচ্ছায় রাজসাক্ষী হতে চান। জানাতে চান, সরকার ও পুলিশের ‘অপকর্মের’ ফিরিস্তি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি তার লিখিত বক্তব্যে আদালতকে বলেন, ‘আমি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছি। জুলাই-আগষ্টের আন্দোলন চলাকালে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ আমি আদালতে তুলে ধরতে চাই। রহস্য উন্মোচনে আদালতকে সহায়তা করতে চাই।’

আদালত মামুনের আবেদন গ্রহণ করলে তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ সাবেক আইজিপির নিরাপত্তা চান। কারাগারে তাকে পৃথক সেলে রাখার আবেদন করেন।

আইজিপি মামুন
আদালত চত্বরে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

কে এই আব্দুল্লাহ আল মামুন
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা মামুনের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শাল্লার শ্রীহাইল গ্রামে। তার স্ত্রী হলি ফ্যামেলি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তৈয়বা মুসাররাত চৌধুরী। দাম্পত্য জীবনে দুইপুত্র ও এক কন্যার জনক মামুন।

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায়। এরপর তিনি ১৯৯১-১৯৯৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায় অপরাধ বিভাগের উপ-সুপারিনটেনডেন্ট, ১৯৯৩-১৯৯৫ সালে গাজীপুর জেলার উপ-সুপারিনটেনডেন্ট (সশস্ত্র পুলিশ) এবং ১৯৯৫-১৯৯৭ সালে সিআইডিতে উপ-সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মামুন ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে হবিগঞ্জে এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে সিলেটের এসডিপিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০০ সালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর  ২০০০-২০০১ সালে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর দপ্তর) এবং রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সেস ও পিটিসিতে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে নীলফামারীর এসপি হন। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি নড়াইলের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে তিনি এআইজি পদে ডিএমপিতে ডিসিপি (নিরাপত্তা) পদে দায়িত্ব পালন করেন।

২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি  থাকার পর মামুন পুলিশ সদর দপ্তরে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত র‍্যাবে এডিজি পদে চাকরি করেন।

মামুন ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। ২০২১ সালের অক্টোবরে তাকে অতিরিক্ত আইজি গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব পালন করেন র‌্যাব মহাপরিচালক হিসাবে।

চাকরির মেয়াদপূর্তির তিনমাস আগে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আইজিপি নিযুক্ত হন। তিনি পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৩০ সেপ্টেম্বর।

সরকারি চাকরির বয়সসীমা অনুযায়ী মামুনের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারী। কিন্তু সরকার ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারী থেকে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত তাকে দেড় বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে টানা চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতাসীন করতে আইজিপি মামুন বিশেষ ভূমিকা রাখেন বলে আলোচনা ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় মামুনের চাকরির মেয়াদ ২০২৪ সালের ৫ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট মামুনের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়, তাকে পুলিশ প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে মো. মইনুল ইসলামকে নতুন আইজিপি করা হয়।

আইজিপি পদ থেকে সরানোর পর মামুনকে ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তাকে উত্তরা পূর্ব ও পশ্চিম থানায় দায়ের করা ছয়টি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন হত্যা মামলায় মামুনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

আলোচিত চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরিবারের সদস্যরা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। মামুনের ছোটভাই আলামীন চৌধুরী সুনামগঞ্জে নৌকা প্রতীকে জয়ী হয়ে শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। পরে আলামীন চৌধুরী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিরাই-শাল্লা আসনে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে  স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়া সেনগুপ্তের (প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী) কাছে হেরে যান।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *