১৯-জুলাইয়ের-আয়রনি

জসীম আহমেদ
4 Min Read
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সহিংসতার পর শহরজুড়ে সেনা টহল। ছবি: অনিক রহমান/ টাইমস

১৯ জুলাই, ২০২৪। ইতিহাসের এই দিনে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সেদিন হোঁচট খেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার, সারাদেশে নামিয়েছিল সেনাবাহিনী। সেদিন গুলিতে ঝরেছিল বেশ কিছু তাজা প্রাণ।

তবে ঠিক দুই সপ্তাহ পর, ৩ আগস্ট সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বক্তব্য দেন, যা ছিল এক নতুন আশাবাদের সূচনা। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘সমস্যাটা রাজনৈতিক, এর রাজনৈতিক সমাধান হতে হবে। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক উপকরণ হবে না।’

সেনা প্রধানের ওই ঘোষণা যেন ছিল রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে সুস্পষ্ট লক্ষণরেখা দাগিয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়াস। তখন প্রমান হয়েছিল, অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার সেনাবাহিনী জনগনের হতে পেরেছে।

কিন্ত এক বছরের মাথায় সেই বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে গোপালগঞ্জ। বছর ঘুরে আবারও সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহারে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

এ বছর ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে ঘিরে গোপালগঞ্জ পরিনত হয় রণক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষে

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা যান পাঁচজন। নিহতদের মধ্যে কেউ রিকশাচালক, কেউ কাপড় ব্যবসায়ী, কেউ বা নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন। কেউ পথচারী, কেউ রাস্তায় দাড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। কেউ হয়তো শুধু ক্রোধ, বঞ্চনার ক্ষোভ, বা কিছুটা উসকানিতে নেমেছিলেন পথে। বিনিময়ে বুক পেতে নিলেন বুলেট। নিহতদের পরিবারের দাবি তাঁরা কেউই রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বিবৃতি দিয়ে মুখ রক্ষা করল। কিন্তু সেই ব্যাখ্যার পাশে ভিডিও ফুটেজগুলো দাঁড় করালে যেন পাল্টা এক প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে—যেখানে জনতা ইট ছুঁড়েছেন, কোথাও লাঠির ঝনঝনানি শোনা গেছে, কিন্তু বেসামরিক জনতার পক্ষ থেকে গোলাগুলির প্রমাণ এখনও নেই।

গোপালগঞ্জের সহিংসতায় নিহত রমজানের বাবা-মার আহাজারি। ছবি: অনিক রহমান/টাইমস

তাহলে যৌথবাহিনী কেন গুলি চালালো? তাদের প্রশিক্ষণ কি যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য, না কি তাদের যুদ্ধাস্ত্র সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ দমনের জন্যও?

সংঘর্ষের মাঝেই এনসিপির শীর্ষ নেতারা যখন সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানে এলাকা ছাড়েন, আর সরকারের উপদেষ্টারা কন্ট্রোল রুমে বসে ‘মনিটরিং’ করেন পরিস্থিতি, তখন ওই প্রশ্নগুলো আরও তীব্র হয়। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাবাহিনী কতটা সমন্বিতভাবে কাজ করেছে, সে প্রশ্নও এখন যৌক্তিক।

এই মুহূর্তে সারাদেশে এনসিপির সমাবেশে নিরাপত্তা দিচ্ছে যৌথবাহিনী। যেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কথা বলে ওই দলটির পাশে অবস্থান নিয়েছেন তারা। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন—এই পৃষ্ঠপোষকতা দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে সম্ভাবনা ম্লান তো হবেই, ভেঙে পড়তে পারে কাঙ্খিত গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড।

আরো প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের সময়ও যদি সেনাবাহিনী একটি দলকে এভাবে আগলে রাখে তাহলে, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন কোন ভরসায়? অস্ত্রের ছায়ায় তারা কি পারবেন সুষ্ঠুভাবে রায় দিতে? নাকি আতঙ্ক, নিস্পৃহতা আর অনিশ্চয়তা তৈরি করবে এক নতুন ‘নির্বাচনী বাস্তবতা?

অফিসার এড্রেসে সেনাপ্রধান আরো বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনী এই সমাজেরই অংশ।’

তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষের রক্তে কেন হাত রাঙালো জণগনের আশা আকাংখার প্রতিক এই বাহিনী? আর যদি সত্যিই সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়, তাহলে সেনা প্রধানের সেদিনের বক্তব‍্যই হয়ে যায় অসার।

বাংলাদেশের মানুষ বহুবার রক্ত দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। এই সেদিনই জুলাই অভ্যুত্থানে ঝরেছে হাজারো তাজা প্রাণ। সেনাবাহিনীকে এই রক্তে না রাঙিয়ে বরং সংবিধানের ছায়ায় রাখাই হবে রাষ্ট্রের পরিণতিবোধের পরিচয়। আর তা নির্ভর করছে আগামী দিনে আমরা অস্ত্রের ছায়ায় রাজনীতি দেখতে চাই, নাকি সংলাপ আর সাহসের আলোয় দেখব গণতন্ত্রকে, সে প্রশ্নও বহাল রইলো।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *