হাসিনা নিজেই আ.লীগের ধ্বংসের কারণ: আনু মুহাম্মদ

বিপ্লব রহমান
5 Min Read
অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ছবি: টাইমস

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে তার দল আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে টাইমস অব বাংলাদেশকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ ধ্বংসের উপাদান অনেক আগে এর ভেতরেই তৈরি হয়েছিল। আর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা নিজেই ছিলেন আওয়ামী লীগের জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ।’

৭৬ বছরের পুরনো দলটির ধ্বংসের সূচনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ভেতরেই এর ধ্বংসের সূচনা হয়েছিল। স্বৈরশাসক হিসেবে শেখ মুজিব দলের ভেতরেও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাশাপাশি তার দল লুটপাটকারী, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল।’

‘কিন্তু ৬০ দশকের গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭২ এ ক্ষমতায় আসার কারণে শেখ মুজিবের বিশাল প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ছিল দলের ভেতরে নির্ধারক ভূমিকায়। এ কারণে বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগের দলীয় একনায়কতন্ত্র সেভাবে প্রকাশ পায়নি। তাছাড়া দলটি সে সময় মাত্র তিন বছর ক্ষমতায় ছিল’, যোগ করেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘কিন্তু সবশেষ গত ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বৈরাচারে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি দলের ভেতরেও স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শাসনতন্ত্রে মন্ত্রীবর্গ যেমন এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না, তেমনি দলের সভানেত্রীর সিদ্ধান্তই ছিল শেষ কথা। দলের ভেতরে কোনো রকম গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কারণ ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই।’

‘বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে’…জুলাই অভ্যুত্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন অকুতোভয় ছাত্র-জনতা। ছবি: অনিক রহমান/টাইমস

আনু মুহাম্মদ বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘ক্ষমতার ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ একটি লুটেরা, চাঁদাবাজ, কমিশনভোগী, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের দলে পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও এটি পরিণত হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর দলে। শাসকগোষ্ঠির ছত্রছায়ায় বেক্সিমকো, সামিট, বসুন্ধরার মতো ব্যবসায়ীক গ্রুপগুলোকে দেওয়া হতো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। আওয়ামী লীগ ক্রমেই রাজনৈতিক দলের চরিত্র হারিয়ে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ধারণ করেছিল।’

‘দুর্নীতি-লুটপাটের আবর্তে ১৫ বছর যেমন গণতান্ত্রিক শাসন ছিল না, কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি, তেমনি দলের ভেতরে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল দুর্নীতি-লুটপাট। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলের অন্যান্য সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় পদ তো বটেই, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের পদও লাখ-কোটি টাকায় বিক্রি হতো। টাকার বিনিময়ে এসব পদ কিনতে হতো, কারণ দুর্নীতি-লুটপাট করার জন্য এসব পদগুলোকে ব্যবহার করা হতো’, যোগ করেন তিনি।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কী, এমন প্রশ্নের জবাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘শেখ হাসিনাসহ বর্তমান নেতৃত্বের হাতে আওয়ামী লীগের কোনো ভবিষ্যত নেই। দলের ভেতরে যদি কোনো প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রমনা থাকেন, তারাও এই নেতৃত্বকে আর কখনোই বিশ্বাস করবে না।’

‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচারে হত্যা, শাসন আমলে লুটপাট, দুর্নীতি ও দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিচার হতে হবে। এরপর হত্যা, লুটপাট ও অপরাধের সাথে জড়িত নন, এমন নেতারা যদি তাদের দলের কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চান, অতীতের ভুল-ভ্রান্তি-অপরাধ থেকে শিক্ষা নেন, তাহলে দলটিকে আবার নতুন করে গোছাতে হবে। যদি জনগণ তাদের আবার আস্থায় নেয়, তবেই দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে আওয়ামী লীগ,’ বলেন তিনি।

‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক

সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এসব হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবাদী কোনো কর্মকাণ্ড জনগণ মেনে নেবে না। ভারত আওয়ামী লীগের বড় বন্ধু হলেও তারা হয়তো এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম মানবে না। এরপরেও বিভিন্ন অপশক্তি আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে দেশের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সেদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি জনগণকে সজাগ থাকতে হবে।’

‘৩৬ জুলাই খ্যাত’ গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী দুঃশাসনের পতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে এটি কিন্তু ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থান নয়। আসলে স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঘনীভূত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সর্বোচ্চ বিস্ফোরণ এই অভ্যুত্থান।’

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘২০১৪ সালের মেয়াদ উত্তীর্ণ সরকার যখন প্রহসনের নির্বাচনে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনায় স্বৈরাচারি শাসন কায়েম করে, তখন থেকেই জনগণের মধ্যে এ সরকার বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, “মেগা প্রকল্পে মেগা বাণিজ্য”, বিদেশে অর্থ পাচার চরমে পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তারা যেন দেশের মালিক, হাসিনা সরকার এমন মনোভাব থেকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে মিথ্যাচারের পাশাপাশি পুলিশ-র‌্যাব-ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ ব্যবহার করে, ডিজিটাল আইনসহ অপরাপর কালো আইনে খুন, জখম, জেল-জুলুমের জোর-জবরদস্তির শাসন কায়েম করেছিল। তাদের লুটপাট-অত্যাচার তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়েছিল।’

‘এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র বাতিলের, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলন, পেশাজীবীদের আন্দোলন ও সবশেষ কোটা বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে “এক দফার আন্দোলনে” সাফল্য এসেছে।’

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *