রাষ্ট্র মেরামত হোক দৃশ্যমান পরিবর্তনে

জসীম আহমেদ
4 Min Read
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর লেখা গ্রাফিতি। ছবি: উইকি

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিচার সংস্কার, নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো। এটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাভাবিক।

বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারহীনতা রাষ্ট্রকে যে গভীর সংকটে ফেলেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য একটি অন্তর্বর্তী কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সাধারণ মানুষ এসব সংস্কারের উদ্যোগ কতটা অনুভব করছেন? অভিজ্ঞতা বলছে, সংস্কারের এসব গুরুতর বিষয় শুধুমাত্র বরাবরই উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থেকে গেলে তা সাধারণের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জনগণ চায় হাতে কলমে দৃশ্যমান সংস্কার বা পরিবর্তন, যা তাদের জীবনযাত্রাকে সরাসরি প্রভাবিত করে।

এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এখন সময় এসেছে কিছু ‘দৃশ্যমান সংস্কার’ করা, যা হবে সরকারের মাইলফলক। আবার এসব সংস্কার হওয়া চাই সরাসরি জনসম্পৃক্ত, বাস্তবায়নযোগ্য এবং দ্রুত ফলপ্রসূ।

আশু পরিবর্তনে চাই রোডম্যাপ:

রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে ট্রাফিক নৈরাজ্য এখন নাগরিক ভোগান্তির শীর্ষে। অপ্রয়োজনীয় হর্ন, বেপরোয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, যত্রতত্র পার্কিং ও সড়ক দুর্ঘটনা– সড়কে এসব নৈরাজ্য যেন নিত্য পিষ্ট করছে নগর জীবন। যানজটে যে কেবল জন দুর্ভোগই হচ্ছে, তা নয়, বিপুল কর্মঘণ্টায় আর্থিক ক্ষতিও কম নয়।

ঢাকার খাল ও ফুটপাত অরক্ষিত অনেককাল ধরে। দখলদারদের কবল থেকে খাল উদ্ধার মানে শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, একই সঙ্গে তা জলাবদ্ধতারও বাস্তব সমাধান। অন্তর্বর্তী সরকার যদি দু-একটি খালও সফলভাবে উদ্ধার করে সৌন্দর্যবর্ধন করতে পারে, তবে তা হবে জনগণের কাছে দৃশ্যমান অর্জন।

আবার গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু ফুটপাত হকারমুক্ত করে অস্থায়ী কিছু হকার্স মার্কেট করা গেলে ধীরে ধীরে তা হকারদের পুনর্বাসনের পথ দেখাতে পারে। নগরবাসীরও হেঁটে চলাচল হয় নির্বিঘ্ন, ফুটপাতের চাঁদাবাজীকে কেন্দ্র করে অপরাধ বাণিজ্যও পাবে কমে আসবে।

ডেঙ্গুর মৌসুম সামনে। প্রতিবারই দেখা যায় নগর পরিচ্ছন্নতায় ও মশা নিধনে ধীরগতি, দায়িত্বহীনতা। এবার ওয়ার্ডভিত্তিক মশা নিধন, সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা এবং আগেভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে নাগরিকের জন্য দৃশ্যমান অগ্রগতি। একইসঙ্গে, স্বাস্থ্যখাতের দুর্দশা নিরসনে অন্তত একটি সরকারি হাসপাতালকে দুর্নীতিমুক্ত করে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা গেলে জনগণের আস্থা বহুগুণে বাড়বে।

 

লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজার যেন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের কাছে পরিনত হয়েছে বিভীষিকায়। বাজার সিন্ডিকেটে চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে সবজির বাজার অস্থির করে রেখেছে। মাছ-মাংস ক্রমেই চলে যাচ্ছে নাগলের বাইরে। সরকারের পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার বিষয়ে আশার বাণী শোনালেও এখনও তা রয়ে গেছে অধরাই। যে কেনো মূল্যে বাজার সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দিয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারিতে নিত্যপণ্যের দামে শৃঙ্খলা ফেরান গেলে তা হবে বড় ধরণের দৃশ্যমান পরিবর্তন।

দেশজুড়ে অনেক সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা জনদুর্ভোগের বড় কারণ। যানজটের পাশাপাশি ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটে পণ্য পরিবহনে যেমন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি বাড়ছে প্রাণঘাতি দুর্ঘটনাও। জরুরিভিত্তিতে এমন কিছু ব্যস্ত সড়ক-মহাসড়ক ও সেতু মেরামত করা গেলে তা সরাসরি জনগণকে সুফল দেবে।

এ সরকার নির্বাচিত না হলেও গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বলে তার জনভিত্তি আরো শক্তিশালী, এ সরকারের কাছে জনগণের আকাঙ্খাও অনেক বেশি। সম্প্রতি পলিথিন নিষিদ্ধের চেষ্টার মতো ব্যর্থ উদ্যোগের বাইরে উল্লেখিত কার্যক্রমগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত রোডম্যাপ নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ জনজীবনে স্বস্তি ফেরাবে।

জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদে দৃশ্যমান ফলাফল আনা গেলে সেটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যত বৈধতার ভিত্তি।

তাই, রাষ্ট্র মেরামতের সূচনা হোক সাধারণ মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনা দিয়ে—এটিই এখন সময়ের দাবি।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *