রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নাটকীয় পালাবদল

জসীম আহমেদ
3 Min Read
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। ছবি: অনিক রহমান/টাইমস

এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরিত্র নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। গত বছর এই দিনে—১৬ জুলাই ২০২৪—দেশের রাজপথে ছাত্রমিছিলে গুলি চালিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই ছাত্র নেতাদেরই গঠন করা রাজনৈতিক দল—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

বুধবার তাদের নেতৃত্বেই শেখ হাসিনার নিজের জেলায় অনুষ্ঠিত হলো ‘গোপালগঞ্জে জুলাই পদযাত্রা’ । কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়—এইবার সেই একই বাহিনী গুলি ছুড়েছে, তবে ছাত্রদের উপর নয়, বরং তারা চড়াও হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মীদের লক্ষ্য করে, আর নিরাপত্তা দিয়েছে সাবেক ছাত্র নেতাদের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের রাজনীতির এক গভীর রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি। এক বছর আগের ঘটনার স্মৃতি এখনো তাজা—যেখানে দেশের বড় শহরগুলোতে ছাত্রদের মিছিলে জলকামান, টিয়ার গ্যাস, এবং গুলি চালানো হয়েছিল। অথচ আজকের গোপালগঞ্জে সেই সাবেক ছাত্রদের বাঁচাতেই সেনাবাহিনী নামানো হলো, পুলিশ ছুড়লো সাউন্ড গ্রেনেড এবং ফাঁকা গুলি।

বেলা পৌনে তিনটার দিকে শহরের পৌর পার্কে যখন এনসিপির সমাবেশ শেষ হচ্ছিল, তখন চারদিক থেকে হামলার মুখে পড়ে তাদের গাড়িবহর। সমাবেশস্থলে উপস্থিত সেনা-পুলিশ সদস্যরা প্রথমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রয়োগ করা হয় রাষ্ট্রীয় বল। পরে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে এনসিপি নেতাদের গোপালগঞ্জের বাইরে পৌঁছে দেওয়া হয়।

 গোপালগঞ্জ—যে জেলা একসময় আওয়ামী লীগের দুর্গ ছিল—তা এখন রাজনৈতিকভাবে একটি প্রতীকী ময়দান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার পতনের পর এই জেলা থেকেই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ প্রতিরোধ দেখা গিয়েছিল। একমাত্র এখানেই তাদের কিছু সংগঠিত নেতাকর্মী তখনো সক্রিয় ছিলেন। তবে সামরিক অভিযানে সেইসব নেতাকর্মীদের একাংশ গ্রেপ্তার হন, বাকিরা আত্মগোপনে চলে যান।

সেই বাস্তবতায়, এনসিপির গোপালগঞ্জে পদযাত্রা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার নতুন বলয়ের একটি রাজনৈতিক ঘোষণা। কিন্তু এমন এক পদযাত্রায় ফের মুখোমুখি সংঘর্ষ, পুলিশের গাড়ি ও ইউএনওর গাড়িতে হামলা, সমাবেশে হামলা ও  অগ্নিসংযোগ এবং আওয়ামী লীগ-পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা আবার গোপালগঞ্জকে নিয়ে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে।

গোপালগঞ্জে নিহত
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সহিংসতার পর শহরজুড়ে সেনা টহল। ছবি: অনিক রহমান/ টাইমস

বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির এই পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে দ্বিমুখী ফল বয়ে এনেছে। একদিকে এটি সামরিক-সমর্থিত সরকারের পক্ষ থেকে এনসিপির ‘রাজনৈতিক কর্মসূচির নিরাপত্তা নিশ্চিতের’ বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে নতুন করে চর্চা ও তৎপরতার রসদ জুগিয়েছে।

এই পদযাত্রা সরকারের সহয়তায় এনসিপির পক্ষ থেকে সাহসী বার্তা হলেও, একই সঙ্গে এটি আওয়ামী লীগের শেষ অবশিষ্ট সংগঠনের ঘাঁটিকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে।

এনসিপির গোপালগঞ্জে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি এবং তার জেরে উদ্ভূত সহিংসতার ছবি ইতিমধ্যে উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এতে করে দেশের রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া আওয়ামীলীগ হয়ে ওঠছে প্রাসঙ্গিক।

তবে একটি বিষয় আবারো স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির নাট্যমঞ্চে এক সময় যারা নিপীড়নের শিকার ছিলেন, এখন তারাই রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগের আশ্রয়ে নিরাপদ। আর যারা এক সময় বল প্রয়োগের ক্ষমতায় ছিলেন, এখন তারাই পাল্টা নিপীড়নের মুখে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তর্নিহিত সংকট ও বাস্তবতাকে সামনে এনে দিয়েছে।

এনসিপি এই পরিস্থিতিকে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে কতটা কাজে লাগাতে পারে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। আর আওয়ামী লীগ কি তাদের এই নতুন পাওয়া মনোযোগকে সাংগঠনিক রূপ দিতে পারবে—তা নিয়ে আছে বড় প্রশ্ন।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *