বগুড়ার শাজাহানপুরের শাহনগর, কামারপাড়া, খোট্টাপাড়া, দুরুলিয়া, বড়পাথার, দরিকুল্যাসহ আশপাশের এলাকা সবার কাছে পরিচিত ‘নার্সারিপল্লী’ নামে। পুরো এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয় হাইব্রিড মরিচে চারা। পরে সেসব বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ভূমিকা রাখে দেশের মরিচ উৎপাদনে।
চলতি মৌসুমে পল্লীর ২০০ নার্সারিতে তিন দফায় ২৪ কোটি হাইব্রিড মরিচের চারা উৎপাদন ও বিপণনের প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সেজন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন নার্সারি মালিক ও শ্রমিকরা।
শাজাহানপুরে উৎপাদিত এসব মরিচ কিনতে আসেন বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নাটোর, গাইবান্ধা, রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের চাষীরা। এছাড়া দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, মঠবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ এবং চট্টগ্রামসহ অন্তত ৩০ জেলায় এখান থেকে চারা সরবরাহ করা হয়।
শাহনগরের নাহিদ নার্সারির মালিক আপেল মাহমুদ জানান, প্রতিদিন খুব ভোর থেকে এখানে বিভিন্ন যানবাহনের আনাগোনা শুরু হয়। দূর-দুরান্ত থেকে নার্সারিপল্লীতে চারা নিতে আসা চাষীদের পদচারণায় মুখরিত ওঠে এলাকা।
বাইরের জেলা থেকে চারা কিনতে অনেক চাষী আগের দিন রাতেই এখানে চলে আসেন। পরদিন সকালে চারা নিয়ে ফেরেন তারা। কেউ কেউ কুরিয়ার-পার্সেলের মাধ্যমেও নিজ জেলায় বসেই কিনছেন এখানকার উন্নত মানের হাইব্রিড মরিচের চারা।
শাহনগরের অভিজ্ঞ নার্সারি মালিক-শ্রমিকরা মরিচের চারার পাশাপাশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুনসহ সব ধরনের সবজির চারাও উৎপাদন করছেন বলে জানান আপেল মাহমুদ।
চলতি বছরের পুরো চিত্র পাওয়া যায় দরিকুল্ল্যার সততা নার্সারির মালিক মোমিনুল ইসলামের কথায়। তিনি জানান, চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি বেড প্রস্তুত করে প্রথম দফায় নার্সারিতে মরিচের বীজ বপন করা হয়েছিল।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সেখান থেকে চারা উত্তোলন শুরু হয়। কিন্তু শুরুতে প্রচণ্ড তাপদাহ এবং পরে অতিবৃষ্টির কারণে মরিচ চাষে নানান প্রতিকূলতায় পড়তে হয় চাষিদের। ফলে প্রথম দফায় উৎপাদিত অধিকাংশ চারা নার্সারিতেই নষ্ট হয়ে যায়। সামান্য যে পরিমাণ চারা বিক্রি হয় তাতে তেমন দাম মেলেনি।
পরবর্তী সময়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় আগস্টের মাঝামাঝি দ্বিতীয় দফায় চারা উৎপাদন করা হয়। সে চারা বিক্রি হচ্ছে ভালোই। জাত ভেদে প্রতি হাজার চারা বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। চারা বেচাকেনা চলবে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত।
নজরুল, ইসরাফিল, খোরশেদ আলমসহ বেশ কয়েকজন নার্সারি মালিক জানান, শাজাহানপুরের শাহনগর, কামারপাড়া, দুরুলিয়াসহ আশপাশের নার্সারিগুলোতে হাইব্রিড মরিচের মধ্যে কারিশমা, টাইগার, কিসমত, সুলতান, লাইলা, ১৭৫৩, লাইট মাস্টার, ময়নামতি, গ্রীন সুপার মরিচের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। রোগবালাই কম এবং ফলন বেশি হওয়ায় চাষিদের কাছে এসব জাতের চাহিদাও বেশি।
প্রায় ৪০ বছর আগে শাহনগরে বাণিজ্যিকভাবে সবজি চারা উৎপাদনের সূচনা করেন আঁখি বীজ ভান্ডার ও এই নার্সারির স্বত্বাধিকারী তরুণ উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন। তার হাত ধরেই ‘চারার নগর’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি পায় শাহনগর গ্রাম। এরপর পর্যায়ক্রমে আশপাশের গ্রামগুলোতেও গড়ে ওঠে সবজি চারা উৎপাদনের নার্সারি।
আমজাদ হোসেন জানান, মাঠ ফসলের চেয়ে চারা উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় দীর্ঘ কয়েক দশকে শাহনগর ও আশপাশের এলাকায় ছোট বড় ২০০ নার্সারি গড়ে উঠেছে। এসব নার্সারিতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৩০০০ শ্রমিক কাজ করছেন। নার্সারিপল্লীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বীজ, কীটনাশক, সারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।
চারা উৎপাদন ও সবজি চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন উল্লেখ করে শাজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমিনা খাতুন জানান, রোগমুক্ত সুস্থ সবল চারা উৎপাদনের জন্য দরকার উপযুক্ত মাটি ও দক্ষ কারিগর। যা শাজাহানপুরে রয়েছে। তাপদাহ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ সবধরনের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আধুনিক কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে বছর জুড়ে চলছে চারা উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ। এ কাজে উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।