মিরাজের টোটকা আর পুরনো অ্যাকশনেই সফল তানভীর

টাইমস স্পোর্টস
6 Min Read
পুরনো অ্যাকশনে নতুন শুরু তানভীর ইসলামের। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

শ্রীলংকার বিপক্ষে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে নিজের প্রথম ওভারটা ঠিকঠাকই করেছিলেন তানভীর ইসলাম। কেবল শেষ বলটাতেই একটু হিসেবের গড়বড়ে কুশাল মেন্ডিসের কাছে হজম করলেন বাউন্ডারি। পরের ওভারে সেই কুশালের কাছেই খেলেন বেধড়ক মার, দুই চার ও এক ছক্কায় গুনলেন ১৭ রান। প্রথম স্পেলের দুই ওভারে ২২ রান দিয়ে উইকেট শূন্য। অথচ অমন শুরুর পরেও মাত্র এক ম্যাচ আগে অভিষিক্ত হওয়া তানভীর হলেন ম্যাচ সেরা। দলও ১৬ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজে ফিরেছে ১-১ সমতায়। বল হাতে দুর্দান্ত কামব্যাকে এই বাঁহাতি স্পিনার ক্যারিয়ারে প্রথমবার নিলেন পাঁচ উইকেটে। যে সাফল্যের নেপথ্যে আছে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের ভরসা যোগানো কিছু কথা আর তানভীরের পুরনো বোলিং অ্যাকশন।

গত মে মাসে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যায় বাংলাদেশ। দুই ম্যাচে খেলেছিলেন তানভীর। প্রথম ম্যাচে ৩০ রানে এক উইকেট, দ্বিতীয় ম্যাচে ৩৭ রানে নেন এক উইকেট। অমন খরুচে বোলিংয়ের পেছনে দায় ছিল তানভীরের খানিকটা নতুন বোলিং অ্যাকশনের। যেখানে জোরের ওপর করতে চাইতেন ব্যাক অফ লেংথ ডেলিভারিগুলো। এতে করে বোলিংয়ের লাইন লেংথের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। ফলস্বরুপ আরব আমিরাত সিরিজে দুই ম্যাচেই ছিলেন খরুচে। এরপর পাকিস্তান সফরে দলের সাথে গেলেও কোনো ম্যাচ পাননি, পেছনের কারণ এই নতুন অ্যাকশন। গতির জন্য পুরো শরীর ব্যবহার না করে টার্ন আর লাইন-লেংথেই বাড়ান মনোযোগ।

তাই বাধ্য হয়ে আবার নিজের পুরনো বোলিং অ্যাকশনেই ফিরে আসেন তানভীর। কারণ পাকিস্তান সফরে তার এই নতুন বোলিং অ্যাকশন পছন্দ করেননি টিম ম্যানেজমেন্টের অনেকেই। শনিবার ম্যাচ সেরা হয়ে অধিনায়ক মিরাজের সাথে সংবাদ সম্মেলনে এসে তানভীর নিজেই জানালেন, কেন পুরনো অ্যাকশনে ফিরেছেন তিনি। ২৮ বছর বয়সী এই বাঁহাতি স্পিনার বলেন, ‘পাকিস্তান সিরিজ চলাকালীন আমি আমার বোলিং অ্যাকশন বদলাই। অনেকে সেটা নেতিবাচকভাবে নেয়, কারণ আমি ২০১৩ সাল থেকে ওই অ্যাকশনেই বল করছিলাম। আমি দ্বিধায় পড়ে যাই, কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’

দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সেই সময়টায় তানভীর পাশে পেয়েছেন তার জাতীয় দলের সতীর্থ তাওহিদ হৃদয়কে, ‘তখন হৃদয় আমাকে বলেছিল, “আগের অ্যাকশনে ফিরে যাও। ওই অ্যাকশনেই তুমি তানভীর হয়েছ, ওটাই তোমার সফলতার পথ।” তারপর আমি আবার আগের অ্যাকশনে ফিরে যাই।’

দ্বিতীয় ওয়ানডেতে পুরনো অ্যাকশনে নতুন শুরুটা ভালো হয়নি তানভীরের। প্রথম স্পেলের প্রথম দুই ওভারে ২২ রান দেয়ার পর অবশ্য অধিনায়ক মিরাজ এসে সাহস দিয়েছেন তাকে, ‘যখন আমি ২ ওভারে ২২ রান দিয়ে ফেললাম, তখন অধিনায়ক আমার কাছে এসে বললেন, ‘‘বোলাররাই মার খায়। তুমি পারবে। রক্ষণাত্মক বোলিং করার দরকার নেই। উইকেট নেওয়ার বল করো।’’

নিজের তৃতীয় ওভারেই পান প্রথম সাফল্য, ফ্লাইটেড টার্নিং ডেলিভারিতে নিশান মাদুশকাকে ভেলকি দেখিয়ে বের করে আনেন পপিং ক্রিজ থেকে। কভারের ওপর দিয়ে ইনসাইড আউট শট খেলতে গিয়ে পয়েন্টে হৃদয়ের হাতে ক্যাচ দেন এই ডানহাতি ব্যাটার। প্রথম স্পেলে নিজের শেষ ওভারে পঞ্চম বলে পান দ্বিতীয় উইকেটের দেখা। মাত্র ২০ বলে ফিফটি ছোঁয়া এই ডানহাতি ব্যাটার রীতিমতো উড়ছিলেন প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে। তানভীরের গুড লেংথ বলে স্টেপ আউট করে সিংগেল বের করতে গিয়ে টার্নে পরাস্ত হয়ে লাইন মিস করে বসেন কুশাল। বল প্যাডে লাগার পর জোরালো আবেদনেও সাড়া দেননি আম্পায়ার, পরে রিভিউ নিলে বাজে কুশালের বিদায় ঘণ্টা। কুশাল যেভাবে ব্যাট করছিলেন, তখন তার উইকেট না নিলে ম্যাচের চিত্র অন্যরকমও হতে পারত।

মিরাজ তাকে দ্বিতীয় স্পেলে ফিরিয়েছেন ২৬ তম ওভারে। সেই ওভারের দ্বিতীয় বলেই কামিন্দু মেন্ডিসের উইকেট নিয়েছেন। টার্নিং ডেলিভারিতে লেগ সাইডে খেলতে চেয়ে শেষ মুহূর্তে মানিয়ে নিতে পারেননি এই বাঁহাতি ব্যাটার। শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ ধরেন মিরাজ। চার নম্বর উইকেট দুনিথ ভেল্লালাগের; যিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন তানভীরের বল ঠেকিয়ে দিতে। কিন্তু তানভীরে গুড লেংথে করা বল তার ব্যাট-প্যাড ছুঁয়ে জমা পড়ে জাকের আলীর হাতে। আর পঞ্চম উইকেটটা নিয়েছেন মাহিশ থিকশানাকে বদলি ফিল্ডার রিশাদ হোসেনের হাতে ক্যাচ দিতে বাধ্য করে।

সব মিলিয়ে ম্যাচ শেষে তানভীরের বোলিং ফিগার ১০-২-৩৯-৫। স্পেল অনুযায়ী ভাগ করলে প্রথম চার ওভারে ২৫ রান দিয়ে দুই উইকেট, দ্বিতীয় স্পেলে টানা পাঁচ ওভার করে মাত্র ১৪ রানে আরো দুই উইকেট। আর শেষ স্পেলে তার বাকি থাকা এক ওভার করিয়েছেন মিরাজ, যে ওভারে নিয়েছেন মেইডেন-সহ এক উইকেট। আবার যদি প্রথম দুই ওভার আর শেষ আট ওভারে তানভীরের বোলিংকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়, তখনই ফুটে উঠবে ম্যাচে তার প্রভাব কতখানি ছিল। শেষ আট ওভারে মাত্র ১৭ রান দিয়ে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট।

তিন স্পেলের বোলিংয়ে তানভীর বল করেছেন গুড লেংথকে প্রাধান্য দিয়ে, বিশেষত ডানহাতি ব্যাটারদের বিপক্ষে। পাঁচ উইকেটের চারটাই তিনি পেয়েছেন গুড লেংথে বল করে। এক সিরিজ আগের তানভীর আর এই তানভীরের পার্থক্যও এখানেই; আগের অ্যাকশনে একই লেংথে পিচ হিট করাতেন জোরের ওপর। যেখানে ছিল কন্ট্রোল আর ধারাবাহিকতার অভাব, ফলাফল খরুচে বোলিং স্পেল। আর পুরনো অ্যাকশনে নতুন করে সাফল্য পাচ্ছেন বলের ওপর কন্ট্রোল আর টার্ন করানোর সামর্থ্য ফিরে পাওয়াতে।

অবশ্য রিশাদ হোসেন প্রথম ওয়ানডের আগে অসুস্থ না হয়ে পড়লে তানভীরের হয়তো খেলারই কথা ছিল না এই সিরিজে। রিশাদের অসুস্থতায় কপাল খুলল কোনো ধরনের বয়সভিত্তিক ক্রিকেট না খেলে জাতীয় দলে উঠে আসা তানভীরের। প্রথম ম্যাচের পারফরম্যান্স আর শ্রীলংকার ডানহাতি ব্যাটারদের কথা মাথায় রেখে দ্বিতীয় ম্যাচেও সুযোগ হলো তার। সেই সুযোগটাও কাজে লাগালেন কী দুর্দান্তভাবে!

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *