শ্রীলংকা সফরের গল টেস্ট। দুই ইনিংসেই অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর সেঞ্চুরি। ড্র হওয়া সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৪৮, দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৫*। এমন দারুণ একটা টেস্ট কাটিয়ে শান্ত পরের ম্যাচেই এক ইনিংসে আউট হয়েছেন সিংগেল ডিজিটে, আরেক ইনিংসে ১৯।
একই সফরে টি-টোয়েন্টি সিরিজে লিটন এক ম্যাচে খেলেছেন ৭৬ রানের ইনিংস। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে তিন ম্যাচে তার মোট রান ১৭। শ্রীলংকায় ওয়ানডে সিরিজে জোড়া ফিফটির পর তাওহিদ হৃদয় টি-টোয়েন্টিতেও খেলতে পারেননি বড় ইনিংস। ফরম্যাটভেদে তারা সকলেই মিলে গেছেন এক বিন্দুতে। কমবেশি বড় ইনিংস খেললেও কেউই তারা ধারাবাহিক নন। এই সমস্যা অবশ্য সাম্প্রতিক নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাটারদের ধারাবাহিকতার অভাবে ভুগছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কোচ সোহেল ইসলাম জানালেন, ব্যাটিং ইউনিটের এই অধারাবাহিকতার নেপথ্যের মূল অনেক গভীরে। যেখানে জড়িয়ে আছে দেশীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি, ক্রিকেটারদের মানসিকতা, উইকেটের মানের প্রভাবও। রবিবার দুপুরে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবির বাংলা টাইগার্স প্রোগ্রামের দায়িত্বে থাকা এই স্পিন বোলিং কোচ প্রথমেই দায়টা দিলেন দেশের ক্রিকেটের সংস্কৃতিকে।
ভারতের উদাহরণ টেনে সাংবাদিকদের সোহেল বলেন,আমার কাছে মনে হয়, এটার জন্য আমাদের কালচারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ভারতে দেখেন, ওদের ডমেস্টিক ক্রিকেটটা অনেক কম্পিটিটিভ হয়। সেখানে একশো, দুইশো খুব বড় বিষয় না। আমাদের দেখা যায় একটা রান করলাম, প্লেয়ার-কোচরা সবাই মানসিকভাবে সন্তুষ্ট হয়ে যায়।’
উদাহরণ হিসেবে সোহেল টানলেন তার শিষ্য ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক শান্তর কথা। শ্রীলংকায় এক টেস্টে দুই সেঞ্চুরির পর পরের টেস্টে তার ব্যর্থতা নিয়ে সোহেল বলেন, ‘শান্তর সাথে এই বিষয়ে আমার কথা হচ্ছিল। একটা ছেলে যখন দুই ইনিংসের একশো মারে পরের টেস্টে তাকে আরো রান করা উচিত ছিল। আমাদের দেশে এরকম কোনো এক্সাম্পল নেই। ভারতে কিন্তু এক্সাম্পল আছে। আমরা ওখান থেকে বের হওয়ার চিন্তা করছি, ওভাবে ট্রেন করার চিন্তা করছি। তাদের মেন্টালিটি বদলানোর চেষ্টা করছি।’
বড় রান করার অভ্যাস বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে নেই বললেই চলে। সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবালরা যখন খেলতেন, অন্তত ধারণা করা যেত তাদের মধ্য থেকে কারো না কারো ব্যাট থেকে একটা বড় ইনিংস আসবে। বর্তমান সেট আপে সেই অভাব দূর করতে সোহেল জোর দিতে বললেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। তিনি মনে করেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা বাড়লে বড় রান করাটাও ব্যাটারদের অভ্যাসে পরিণত হবে।
বিসিবির এই স্পিন বোলিং কোচ বলেন, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে আসলে একটা দুইটা ম্যাচ দেখে চিন্তা করি ছেলেদের। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটেও ধারাবাহিকতা কম। এখানে যদি কম্পিটিশন বাড়ে চ্যালেঞ্জ বাড়ে, তাহলে উন্নতি হবে। বড় রান করা, ব্যাক টু ব্যাক রান করা এগুলো কিন্তু অভ্যাসের ব্যাপার। এটা এমন না যে, এক টেস্টে দুইটা সেঞ্চুরি মারছি মানে আমি পরের টেস্টে রান করতে পারব না।’
বাংলা টাইগার্সে প্রোগ্রাম দিয়ে ক্রিকেটারদের মানসিকতায় বদল আনার চেষ্টা করছেন সোহেলরা, ‘আমাদের এই সংস্কৃতিটা ছিল না। কিন্তু শুরু তো করতে হবে। আমরা এখান থেকে ছেলেদের ওভাবে ট্রেন করে ওই ক্ষুধাটা আনার চেষ্টা করছি। লাল বলে ব্যাটার হিসেবে যদি কারো গড় ৫০ হয় তাহলে ঠিক আছে। একটা ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি জায়গায় দুটা টেস্ট খেললেন, আপনার এভারেজ হবে ৮০। এই যে চিন্তা করাটা, এই জায়গাটায় আমরা ছেলেদের পুশ করছি, ছেলেরাও সেভাবে চেষ্টা করছে।’
আন্তর্জাতিক কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটের উইকেট নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। ক্রিকেটার থেকে শুরু করে কোচ, এমনকি অনেক সময় বিসিবির পরিচালকরাও সমালোচনা করেন বাংলাদেশের উইকেটের ধরণ নিয়ে। সম্প্রতি পাকিস্তান সিরিজের উইকেট নিয়েও তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটি। পাকিস্তানের কোচ মাইক হেসন সরাসরিই বলেছেন, এমন উইকেট কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানদন্ডের মধ্যে পড়ে না।
তাই ব্যাটারদের অধারাবাহিকতা, বড় ইনিংস খেলতে না পারার পেছনে সোহেল দায় দিচ্ছেন উইকেটেরও, ‘অবশ্যই এটা সবসময় আমরা বলে আসছি। উইকেটের ওপর ডিপেন্ড করে, একটা ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং প্যাটার্ন কেমন হবে। কেউ যদি লো বাউন্স উইকেট হতে থাকে, তাহলে ব্যাটিংটাও অমন হয়ে যায়। ব্যাটসম্যানরা শটস খেলতে, রিস্ক নিতে ভয় পায়। আপনি যখন যদি শটস খেলতে যাবেন, তাহলে রিস্ক তো নিতেই হবে। আমাদের ব্যাটিং প্যাটার্নের মধ্যে এটা খুব ঢুকে পড়ে। আমরা সাফার করতে থাকি।’