দিন আর রাত। দুই সময়ের মধ্যে কি সত্যিই শুধু সূর্য ওঠা আর ডোবার তফাৎ? না ভাই, আমাদের দেশে এখন দিন-রাত মানেই দুইটা আলাদা জীবন। আলাদা মানুষ। আলাদা কর্মসূচি। দিনের বেলা যারা টাই পরে অফিস যাই, রাত নামলেই তারা প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদে নেমে পড়ি। টাই খুলে টিশার্ট-ক্যাপ, গলায় ঝুলে বিপ্লবী আইডি কার্ড আর বুকপকেটে তাজা আদর্শের নোট।
দিনে অফিসে বস ডাকে, ‘ফাইল জমা দিছো?’ রাতে দলের কেউ ডাক দেয়: ‘অমুক জায়গায় আয়।’
ফেসবুকে হঠাৎ রাত আটটার দিকে দেখি একটা পোস্ট: ‘আজকে রক্ত দিব, কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না!’ পাশে লোকেশন: অমুক ভাস্কর্য।
কী অন্যায়? কে করেছে? কেন এখন? জানি না, জানতে চাইও না। কারণ জানার চেয়ে জড়ো হওয়াই বড় কাজ। কমেন্টে দেখি আগুন: ‘অন দ্য ওয়ে ব্রো।’ লাইক দিয়ে নেতার কমেন্ট: ‘এইবার বুঝবে ওরা!’
দুপুরবেলা যে লোকটা ব্যাংকে কিউ দিয়ে ইউটিলিটি বিল জমা দিল, রাত ১০টায় তাকেও দেখি মুখে মাস্ক, হাতে ব্যানার, চোখে উদ্দীপনা আর গলায় নামছে চা।
দিনে আমি সাদামাটা। একজন ‘কমন ম্যান’। অফিসে গিয়ে কম্পিউটার চালাই, ফাইলে সিগনেচার খুঁজি, চায়ের দোকানে একটু জিরাই।
রাতে আমি বিপ্লবী। রাতে আমি গর্জে উঠি: ‘এই দমন চলবে না, এই নিপীড়ন চলবে না!’
পুলিশ তাকায়, আমি তাকাই। মুগ্ধতায়, সন্দেহে, প্রতিজ্ঞায়। একসাথে।

আমাদের এক বন্ধু আছে যে দিনে টিউশন করে, রাতে স্ট্যাটাস দেয়: ‘আমরা আর চুপ থাকব না।’
আরেকজন, সে শুধু আসে ছবি তুলতে। মোবাইল ঘোরায়, লাইভ দেয়। ক্যাপশন দেয়: ‘মিডনাইট ফর জাস্টিস।’
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এখনকার তরুণেরা ঠিক করে নিয়েছে যে দিন আর রাজনীতির নয়, রাতই রাজনীতির আসল সময়। আর কিছু না হোক, চায়ের দোকানে গলায় ঝাঁঝ দিয়ে বলা যায়, ‘কাল ছিলাম ভাই, অনেক কিছু হইছে।’
দিন আর রাতের এই দ্বৈত জীবন চালাতে গিয়ে সবচেয়ে কষ্ট হয় ঘুম নিয়ে।
রাত তিনটায় বাড়ি ফিরি, সকালে আবার অফিস। বউ বলে, ‘এইটা কেমন জীবন?’ আমি বলি, ‘দিবানিশি বিপ্লবী হইছি রে… এমনি করেই তো বদলায় দুনিয়া!’
বদল আনছি কি না জানি না, তবে ঘুম হারাম করে নিশ্চিতভাবেই বদলে ফেলেছি নিজের শরীর, চেহারা, ঘড়ির অ্যালার্ম এবং পাশের বাসার কুকুরের বিশ্বাস। রাতে বিক্ষোভ মানেই হইচই, সে আর ঘুমায় না।
দেশে আজকাল ‘রাত’ মানেই ‘আন্দোলনের প্রাইমটাইম’। যারা দিনে জ্যামে আটকে থাকে, তারা রাতে স্লোগানে উড়তে চায়। এই হলো আমাদের শহুরে ‘দিবানিশি বিপ্লব’, যেখানে একেকজন মানুষ দিনে একরকম, রাতে ভিন্ন।
ডিসক্লেইমার: একটি পূর্ণাঙ্গ রম্য। শুধুমাত্র হাস্যরসের জন্য পরিবেশিত।