জুলাই গণঅভ্যুত্থানের হত্যা মামলার আসামি, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ব্যাংককের ফ্লাইটে দেশত্যাগের পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে: ১. আইন কি সকলের জন্য সমান? ২. অনেকটা ‘প্রকাশ্যেই’ আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের দায় কার?
শেষ পর্যন্ত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ও এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যা মামলার আসামি আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে ‘সরকার বদ্ধপরিকর’।
সরকারি ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের বিদেশ গমন সম্পর্কে জনমনে ক্ষোভ বিষয়ে সরকার অবগত। এ ঘটনার সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর রয়েছে।’
টাইমস অব বাংলাদেশ ‘গভীর রাতে হামিদের দেশত্যাগ’ শিরোনামে জানাচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৯ মাস পর গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দেশ ছাড়েন আবদুল হামিদ। রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংকক যাত্রা করেন তিনি।
সংবাদপত্রগুলো বলছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ভিআইপি প্রটোকল নিয়েই হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যান এবং গাড়িতে বসেই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন। ব্যাংকক যাওয়ার সময় তার সব কার্যক্রম ছিল পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার জ্ঞাতসারে।
জনমনে তোলপাড় তোলা এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বৃহস্পতিবারই কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হাছান চৌধুরী ও ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফকে প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া, আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জে দায়ের হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আজাহারুল ইসলাম ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এটিএসআই মোহাম্মদ সোলাইমানকে করা হয় সাময়িক বরখাস্ত। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয় তিন সদস্যের কমিটি।
এর আগে জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যার অভিযোগে আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরো কয়েকজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাকেও আসামি করা হয়েছে।
লক্ষ্যণীয়. ১. আব্দুল হামিদের ব্যাংকক যাত্রাকে কোনোভাবেই ‘অবৈধ’ বলা যাবে না। ২. তিনি গোপনেও দেশ ছাড়েননি। ৩. শিডিউল ফ্লাইট গভীর রাতে ছিল বলে সে সময়ই যাত্রা করেছেন তিনি। ৪. এ নিয়ে বিতর্কের মাঝে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ খোলাসা করেছে, তার ওপর ‘দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা’ ছিল না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব শেষ করে ২০২৩ সালে আব্দুল হামিদ তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট জমা দেন এবং একটি বৈধ সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। এ পাসপোর্টটি সরকার বাতিল বা জব্দ কোনোটিই করেনি। আদালত থেকেও তার ‘বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হয়নি।
এ কারণে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কতৃপক্ষ আইন মেনেই তার বিদেশ যাত্রার যাবতীয় কার্যক্রম করেছে।
খবরে প্রকাশ, মাস তিনেক আগে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের কার্যালয় চিঠি দিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি) হামিদের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে অনুরোধ করেছিল। তবে তার ‘বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা’ চেয়ে সরকার পক্ষ থেকে কোনো আদালতে আবেদন জানানো হয়েছিল—এমন কোনো নিশ্চিত তথ্য জানা যায়নি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বিষয়টির তদন্ত চলছে।
আর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘খুনের মামলার আসামি সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বিদেশ যাত্রা ঠেকানো পুলিশের এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব। এটি কোনোভাবেই আইন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে পড়ে না।‘
তিনি আরো বলেন, ‘আমার মন্ত্রণালয়ের আওতায় রয়েছেন কেবল নিম্ন আদালতের বিচারকেরা। নিশ্চয়ই সবার জানা, বিচারকদের কাজ বিমানবন্দর পাহারা দেওয়া বা কারও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা নয়।”
আইন উপদেষ্টা তার নিজের এবং মন্ত্রণালায়ের বিষয়টি খোলাসা করেছেন। কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশযাত্রায় কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকার পরও কিশোরগঞ্গজের এসপি, ইমিগ্রেশনের এডিশনাল এসপিসহ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নেয়া শাস্তিমুলক ব্যবস্থা কতটা যৌক্তিক – এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এমন প্রশ্নও আছে সত্যিকার অর্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার ‘আসামি’ আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে সরকার কেন এই ৯ মাসেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি? তাকে ‘গ্রেপ্তার’ বা ‘গৃহবন্দি’ কোনোটাই করা হয়নি, এমনকি তাকে নজরদারিতেও রাখা হয়েছিল কি না, সেটিও প্রশ্ন।
সকলের নিশ্চয় মনে আছে যে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাতারাতি ধনকুবের বনে যাওয়া সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজির আহমেদের দুর্নীতির খবর একের পর এক গণমাধ্যমে ফাঁস হলে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে এই সব ডামাডোলের মধ্যেই কয়েকশ কোটি টাকা তুলে নিয়ে, বেশ কয়েকটি ব্যাংক একাউন্ট ফাঁকা করে দিয়ে সপরিবার বিদেশে গা ঢাকা দেন বেনজির আহমেদ।
পরে আওয়ামী লীগের সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল এক প্রশ্নের জবাবে যেন কিছুটা রসিকতা করেই সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেনজীর দেশে আছে না বিদেশে আছে, তা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে!’
দৃশ্যতই, সে সময় বেনজিরের ‘দেশত্যাগে’ সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল বাধ সাধেনি। এবারও যেন একই পদাংক অনুসরণ করে নীতি-নির্ধারণী মহল হামিদের ‘দেশত্যাগ’ আটকায়নি।
অর্থাৎ, রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের নীরব সম্মতি, এমনকি যেখানে গোয়েন্দা সহায়তায় হামিদের যাত্রা, সেখানে কেবলমাত্র মাঠ পর্যায়ের পুলিশ ও ইমিগ্রশন কর্মীদের শাস্তি কি ‘উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান’ নয়?
বৈধ পাসপোর্ট, আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকা, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও অবগত থাকা—তাহলে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের শাস্তি দিয়ে কেন দায় এড়ানো?
একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের পরে যদি তদন্ত কমিটিকে বলতে হয়, ‘দেখা হবে কীভাবে তিনি পাসপোর্ট পেলেন’, তাহলে রাষ্ট্রের ভেতরের অভ্যন্তরীণ সমন্বয় ও তথ্যপ্রবাহ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
বেনজির বা হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় সরকারের সদিচ্ছা। আর এ সংক্রান্ত পরবর্তী যা কিছু দৌড়ঝাঁপ, সবই যেন লোক দেখানো, অনেকটা ফকির লালনের সেই গানের মতো, ‘গাছ কেটে জল ঢালো পাতায়, এ চাতুরী শিখলে কোথায়?’
মনে রাখা জরুরি, আবদুল হামিদের বিদেশ যাত্রা নিয়ে বিতর্ক আসলে ‘ভ্রমণের বৈধতা নিয়ে নয়’, এটি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগ্রহণ ও দায়বোধের কাঠামো কতটা কার্যকর তাকে প্রকাশ্য করে, জনসন্মুখে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের নৈতিকতা কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
Splendid write up indeed! Great one