‘এক দফা আদায়ে ঘোষণা করা হয় “মার্চ টু ঢাকা”

টাইমস রিপোর্ট
9 Min Read
শেখ হাসিনার দুঃশাসন অবসানের ‘এক দফা’ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস

 

‘শেখ হাসিনার আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছিলাম। হাসিনার পতনের জন্য গোটা দেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ছিল। আগে সরকারের বা পরে যেভাবেই হোক, তার জুলুমতন্ত্রের পতন ঘটবেই। এ জন্য পতন-পরবর্তী প্রস্তুতি নিয়ে রাখা জরুরি ছিল। নাহিদ ইসলামকে জানিয়ে রাখলাম, অধ্যাপক ইউনুসের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে,’ উত্তাল দিনগুলোর চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ দিনগুলোর কথা এভাবে স্মৃতিচারণায় বলেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক,  বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক গ্রন্থে অভ্যুত্থানের দিনলিপি তুলে ধরেছেন সজিব ভূঁইয়া। গত মার্চে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিত বইয়ে ‘চূড়ান্ত লড়াইয়ের’ শেষ পর্বে তিনি তুলে ধরেন উত্তাল দিনগুলোর কথা।

জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনে আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। ছবি: ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘৩ আগস্ট দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ হলো, হতাহতের ঘটনা ঘটল। সেনাবাহিনীর বৈঠকের দিকে আমরা লক্ষ রাখলাম। বৈঠক শেষে সেনাপ্রধান বললেন, সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থাকবে। বিলম্বে হলেও জনগণের পাশে থাকার এই ঘোষণা আমাদের স্বস্তি দিল। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশের আহ্বান জানাই।’

এক দফা (শেখ হাসিনার পদত্যাগ) ঘোষণার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এক দফা ঘোষণার সময়ও শেখ হাসিনার পতনের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম যে হাসিনার পতন না ঘটলে আমরা মারা পড়বই। তার চেয়ে বড় কথা, এত এত মানুষের আত্মত্যাগ সম্পূর্ণ বৃথা যাবে। শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।’

‘এক দফা ঘোষণার আগের রাতে (২ আগস্ট রাতে) সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ থাকা তৃতীয় একটি পক্ষ থেকে রিফাত ও মাসউদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরদিন সেনাবাহিনীর বৈঠকের আগেই তারা এক দফা ঘোষণার জন্য চাপ দিয়েছিল। সবকিছু মাথায় রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, সেনাবাহিনীর বৈঠকের আগে এক দফা ঘোষণা করা হবে না। পরদিন বৈঠকের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গুলি না চালানোর ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগের নৈতিক শক্তি শূন্যে নেমে যায়। আমরা বুঝতে পারছিলাম, আওয়ামী লীগ এখন তার সর্বশক্তি নিয়ে সর্বোচ্চ আঘাতের চেষ্টা করবে। খবর পাচ্ছিলাম, ট্রাক ও বাসে করে তারা ৪ আগস্টের কর্মসূচির জন্য ঢাকায় লোক জড়ো করছে।’

‘এক দফা ঘোষণার পর সরকারপন্থীরা অনলাইনে নানা ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছিল। তারা বলছিল যে সমন্বয়কদের পালাতে দেওয়া যাবে না। নানা নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে নানা রকমের গুজবও ছড়ানো হচ্ছিল।’

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘৪ আগস্ট ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসাররা ভয় দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগের দিকে লক্ষ্য করে আকাশে গুলিও ছোড়ে। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশেই আওয়ামী লীগ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাঠে ছিল। তারা বহু মানুষকে হত্যা করে। ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় নাহিদ ভাই, বাকের আর আমার শাহবাগে যাওয়ার কথা ছিল।’

‘৩ আগস্ট এক দফা ঘোষণার পর আমাদের মনে হচ্ছিল আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে টেনে নিয়ে যেতে হবে। অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসচি সফল করার জন্য যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। ৩ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে হতাহতের ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। পলিশ সেভাবে গুলি চালায়নি। সেনাবাহিনীও জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা গুলি চালাবে না। আওয়ামী লীগ ঢাকাসহ সারা দেশে দলীয় লোকজন দিয়ে আন্দোলন নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বার্তা পাচ্ছিলাম, আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজন দিয়ে মাঠ দখল করতে পারলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আন্দোলন দমনে তাদের সহযোগিতা করবে। আর আওয়ামী লীগ যদি না পারে, তাহলে সবাই আমাদের পক্ষে চলে আসবে। আওয়ামী লীগের লোকজন পরিকল্পিতভাবে ট্রাকে করে ঢাকায় ঢুকতে থাকে।’

‘৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ছিল গুলিস্তান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরসহ কয়েকটা ভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেওয়া। বেলা ১১টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ ও গণসমাবেশ ছিল। আওয়ামী লীগ যেসব পয়েন্টে অবস্থান নেয়, সেগুলোর চারপাশের অঞ্চল কীভাবে দখলে রাখা যায়, সে রকম একটা পরিকল্পনা সাজানো হয়। আওয়ামী লীগ অবশ্য তাদের ৪ আগস্টের কর্মসূচি বাতিল করে ৫ আগস্টে নিয়ে যায়। আমাদের ধারণা ছিল অস্ত্রশস্ত্র, রামদা ইত্যাদি নিয়ে আওয়ামী লীগ সেদিন মাঠে নামবে। হয়েছিলও তা-ই।’

‘আওয়ামী লীগকে অবরুদ্ধ করে ফেলার জন্য আমরা পরিকল্পনা সাজাই। যেমন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে তাদের আটকে ফেলার জন্য শাহবাগে একটা এবং মৎস্য ভবনের সামনে আরেকটা জমায়েতের পরিকল্পনা ছিল। মাঠে যারা কাজ করত, পরিকল্পনাগুলো গ্রুপের মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠানো হয়।’

‘সে সময়ে আমি ছিলাম মুগদা ওয়াসা রোড এলাকায়। সেখানে কয়েকটা বাসা পরিবর্তন করে করে আমি থাকছিলাম। আমাদের গ্রামের অ্যাডভোকেট ওবায়দুলের মেসে কিছুদিন ছিলাম। আবু বাকের মজুমদারের এক আত্মীয়ের ফ্ল্যাটে ছিলাম এক দিন। ৪ আগস্ট রাতে ছিলাম একই এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক নূর মুহিতের বাসায়। কর্মসূচির সিদ্ধান্তগুলো তখন অনেক কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। কারণ, সবার সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি নির্ধারণের মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল না। আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়া থেকে আমিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মসূচিগুলো ঘোষণা করতাম। নাহিদ ভাইসহ বাকিদের অবগত করা হতো।’

জুলাই অভ্যুত্থান দমনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় যৌথ বাহিনী। ছবি: অনিক রহমান/টাইমস

তিনি বলেন, ‘বাসায় থেকেই আমি সারা দেশের খোঁজখবর নিতে থাকি। বিভিন্ন পয়েন্টে কী অবস্থা, তা অনলাইনে দেখার চেষ্টা করি। সংবাদগুলো দেখে ভাবি, পরসিন কী করা যায়! একপর্যায়ে শোনা গেল, দুপুর বা বিকেলের দিকে আবারও ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে। মনের মধ্যে চাপ অনুভব করি যে এর আগেই তো পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করতে হবে।’

‘৪ আগস্ট দিনভর শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সঙ্গে জনগণের লড়াই হয়। তবে দিনের বেলায় হতাহতের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সন্ধ্যাবেলায় পুলিশও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগ দিয়ে গুলি করা শুরু করে। সন্ধ্যার পর খবর পাই, নাহিদ ভাই বেলা ১১টায় শাহবাগে গিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের কাউকে না পেয়ে বেলা ২টা-৩টার দিকে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন শিক্ষকের বাসায় চলে যান।’

‘ইন্টারনেট আবারও বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং আবার কারফিউ ঘোষণার আশঙ্কায় দুপুরের দিকেই পরের দিন ৫ আগস্টের কর্মসূচি ফেসবুকে ঘোষণা করে দিই। তখন এমন একটা পরিকল্পনা ছিল যে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে মসজিদের মাইক দিয়ে কর্মসূচি জানিয়ে দেওয়া হবে। একটা ভিডিও বার্তায় বলি, ‘আমরা জানতে পেরেছি, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা শঙ্কা করছি যে ইন্টারনেট-ব্রডব্যান্ড সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে আবার দেশে একটি ক্র্যাকডাউন চালানো হবে, মানুষকে হত্যা করা হবে এবং গণহত্যা চালানো হতে পারে আগেরবারের মতো। সেই জায়গা থেকে আমরা আমাদের এই পুরো সপ্তাহের কর্মসূচির আউটলাইন ঘোষণা করে দিয়ে যেতে চাই। আমরা জানি না, ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর সমন্বয়কদের কী হবে। আমাদের আবার তুলে নিয়ে যাবে কি না, মেরে ফেলবে কি না, আমরা জানি না। যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। সে জন্য আমরা কর্মসূচির আউটলাইন ঘোষণা করছি। আমরা না থাকলেও আপনারা এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করবেন। আগামীকাল ৫ আগস্ট সারা দেশে শহীদদের স্মরণে শহীদ হওয়ার স্থানগুলোতে শহীদ স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হবে। বেলা ১১টায় শাহবাগে শ্রমিক সমাবেশ হবে কেন্দ্রীয়ভাবে। বিকেল ৫টায় নারী সমাবেশ হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সারা দেশে বিক্ষোভ ও গণ-অবস্থান চলমান থাকবে। ৬ আগস্ট “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচি ঘোষণা করছি। সারা দেশে যে যেখানে আছে, সেই জায়গা থেকে ৬ আগস্ট মিছিল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন। সারা দেশের ছাত্র-নাগরিক-শ্রমিকদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানাচ্ছি। সব এলাকায় পাড়া-গ্রাম-উপজেলা

করুন। যদি ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউন হয়, আমাদের গুম-গ্রেপ্তার-খুনও করা হয়, যদি ঘোষণা করার কেউ না থাকে, নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একজন নেতাও না থাকে, তবু এক দফা দাবিতে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ দখলে রাখবেন। সারা দেশের প্রতিটি পরিবারের প্রতি আমি আহ্বান জানাতে চাই, এই আন্দোলন ও লড়াই আপনার পরিবার ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লড়াই। তাই আপনার পরিবার থেকে একজন করে হলেও ঢাকার উদ্দেশে রওনা করিয়ে দেবেন, একজন করে হলেও যুদ্ধে পাঠাবেন। এই যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবে। না হলে বাংলাদেশ এক গভীর অমানিশা ও অন্ধকারে ডুবে যাবে,’ যোগ করেন আসিফ মাহমুদ।

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *