২০২৪ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজের ঠিক আগে তিন ফরম্যাটেরই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। যদিও বিসিবি তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত। সেই যাত্রায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে মত বদলান তার। অবশ্য পড়তি ফর্মের কারণে পরবর্তীতে নিজেই সরে দাঁড়ান টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব থেকে। ওয়ানডে আর টেস্টে শান্তকে অধিনায়ক রেখে টি-টোয়েন্টির দল বুঝিয়ে দেয়া হয় লিটন দাসকে।
তবে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ক্রিকেট ফিরে গেল তিন অধিনায়কের যুগে। শান্তকে সরিয়ে আচমকা সিদ্ধান্তে ওয়ানডের অধিনায়ক করা হলো মেহেদী হাসান মিরাজকে। বিকেলে জরুরি এক জুম মিটিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত নেন বিসিবির পরিচালকরা। শুক্রবার সকালে নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক মিরাজও জানান, আগেরদিনই ওয়ানডে অধিনায়কত্বের প্রস্তাব পান তিনি বিসিবি পরিচালক ও ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছ থেকে।
মিরাজ রাজি হওয়াতে তিন বছর পর আবারও তিন ফরম্যাটে তিন অধিনায়কের পথচলা শুরু হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সর্বশেষ ২০২২ সালে তিন ফরম্যাটে আলাদা অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছে বাংলাদেশ। তখন টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন মুমিনুল হক, ওয়ানডেতে তামিম ইকবাল ও টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
বিসিবি সূত্রে জানা গেছে, নতুন বোর্ড সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের চাওয়া ও পরিচালকদের সম্মতিতেই তিন ফরম্যাটের জন্য ভিন্ন অধিনায়ক বেছে নিয়েছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির এক কর্মকর্তা জানান, ‘বোর্ডে নতুন সভাপতি এসেছেন। আসলে বোর্ডে যখন পরিবর্তন আসে, নতুন করে সব গঠিত হয়, তখন অনেক কিছুই বদলে যায়। এসব ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে। বোর্ডের প্রশাসনিক দিক থেকে এমন পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিকই।’
ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদীন ফাহিম এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্যাটে-বলে মিরাজের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স, মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে যেভাবে দলের জন্য অবদান রাখছে; বোর্ড মনে করে দেশের ক্রিকেটের এই বদলের সময়টায় সে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে আদর্শ হতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি মিরাজের মানসিক দৃঢ়তা ও পরিপক্কতা এই ফরম্যাটে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একইসাথে শান্তকেও আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই, অধিনায়ক হিসেবে তার অবদানের জন্য। নেতৃত্বে না থাকলেও লিডারশিপ গ্রুপের অংশ সে। কারণ আমরা জানি, তার ব্যাটিং দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ’।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দলগুলোতে ফরম্যাটভেদে আলাদা অধিনায়ক দেখা যায়। বিরাট কোহলি সরে যাওয়ার পর তিন ফরম্যাটেই ভারতকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রোহিত শর্মা। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে তার অবসরে আবার তিন ফরম্যাটে ভিন্ন তিন অধিনায়ক ভারতের। অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মিচেল মার্শ। ওয়ানডে-টেস্টে প্যাট কামিন্স। ইংল্যান্ডে সাদা বলের দুই ফরম্যাটে নতুন করে দায়িত্ব পেয়েছেন হ্যারি ব্রুক, টেস্টে রয়েছেন বেন স্টোকস।
তাদের এই ‘লাক্সারির’ নেপথ্যে আছে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, সমৃদ্ধ পাইপলাইন ও ফরম্যাটভেদে ভিন্ন দল খেলানোর সক্ষমতা। প্রতি ফরম্যাটের জন্যই কিছু ‘স্পেশালিস্ট’ ক্রিকেটার আছে এই বড় দলগুলোর। যে কারণে ফরম্যাটভেদে দল আলাদা করে ফেলা তাদের কাছে কঠিন কিছু নয়। পাইপলাইন কিংবা পরিকল্পনার আলোচনায় যেখানে যোজন যোজন পিছিয়ে বাংলাদেশ।
সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটও মনে করিয়ে দিলেন সেই কথাটাই। তার ধারণা, খুব বেশি ফলপ্রসু হবে না বিসিবির এই সিদ্ধান্ত, ‘আমাদের বাস্তবতা আসলে আলাদা। পাইপলাইনে আমাদের এত বেশি ক্রিকেটারও নেই যে ফরম্যাট অনুযায়ী আলাদা দল সাজাতে পারব। তিন অধিনায়ক করার সিদ্ধান্তটা আমার কাছে খুব বেশি কার্যকরী হবে বলে মনে হয় না। পারফরম্যান্সেও আহামরি প্রভাব পড়বে না বলেও আমার ধারণা।’
অবশ্য ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্টের বিবেচনায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিসিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘বছরজুড়েই টানা খেলার মধ্যে থাকে ক্রিকেটাররা। তাদের বিশ্রামের ব্যাপারটাও মাথায় রাখা উচিত আমাদের। সেদিক থেকে হিসেব করলে বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত আসলে ঠিকই আছে। দলের ওপর এর একটা পজিটিভ প্রভাব পড়বে আশা করি।’
তিন অধিনায়কের যুগে তো বাংলাদেশ ফিরল ঠিকই। কিন্তু এতে সবচেয়ে বড় জটিলতার শঙ্কা থেকে যায় ড্রেসিংরুমে বিশৃঙ্খলা নিয়ে। কারণ শান্ত, মিরাজ কিংবা লিটন; তিনজনের ক্রিকেট দর্শন, অধিনায়ক হিসেবে চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি সবই আলাদা। অতীতেও তিন অধিনায়কের নেতৃত্বে বেশ কয়েকবার ঝামেলার কথা সামনে এসেছে।
খালেদ মাসুদের মতে, এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্যদের। তাদের অভিভাবকের রূপে দেখতে চান জানিয়ে পাইলট বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্টকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্রিকেট অপারেশন্স আছে, তাদের সবসময়, সবকিছু জানাতে হবে। ক্রিকেট অপারেশন্সের নজরদারি থাকলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না দলে।’
নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক মিরাজকেও সংবাদ সম্মেলনে করা হয়েছিল একই প্রশ্ন। মিরাজও সোজাসাপ্টা জবাবে বলেছেন, ড্রেসিংরুমে নেতৃত্বের পালাবদলের প্রভাব পড়বে না, ‘শান্তর সঙ্গে কথা হয়েছে। ওর সঙ্গে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গেই ক্রিকেট খেলছি। অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে একসঙ্গে আছি। আমাদের যে জিনিসটা মনে হয়, অধিনায়ক তেমন ম্যাটার করে না। দল হয়ে খেলাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, ড্রেসিং রুমে এরকম কোনো প্রভাব পড়বে না। দিন শেষে। আমরা সবাই দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলি।’