বিশ্ব মশা দিবস: উষ্ণ পৃথিবীতে বাড়ছে রোগের বিস্তার

অহনা আনজুম
8 Min Read
প্রতীকী ছবি

সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। ছোট্ট শব্দের এই পতঙ্গে হাঁসফাঁস অবস্থা বিশ্বের মানুষের। বাংলাদেশেও দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে এর মরণ থাবা। মশাবাহিত ডেঙ্গুর মাঝেই চিকুনগুনিয়া নিয়ে নতুনভাবে শঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি এনিয়ে সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দুটি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে সাবধান করছেন বিশেষজ্ঞরাও।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার আতঙ্কে আতঙ্কিত যখন বাংলাদেশের মানুষ তখন অনেকটা অনাড়ম্বরভাবেই পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস।  প্রতি বছর ২০ আগস্ট মশা ও মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য দিবসটি পালন করা হয়।

১৮৯৭ সালের এই দিনে ব্রিটিশ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী স্যার রোনাল্ড রস আবিষ্কার করেন যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাজমোডিয়াম মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার মশাবাহিত রোগ নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে এবং রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই ১৯০২ সালে স্যার রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বিস্তার এখন নিয়ন্ত্রণহীন। মঙ্গলবার পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী দেশে এক বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ।

ঢাকার হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ছবি : টাইমস
ঢাকার হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ছবি : টাইমস

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৭ হাজার ১২৫, মৃত্যু হয়েছে ১০৫ জনের।

গত বছর মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৭৫, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। মৃত্যুর এ সংখ্যা ডেঙ্গুর এর আগের ২৪ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও রোগীর সংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে ২০২৩ সালে। সে বছর এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আক্রান্ত হয়েছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন মানুষ।

কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘বিশ্ব মশা দিবস মূলত মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি, প্রতিরোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই পালিত হয়। মশা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বিবেচ্য। প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার ও জাপানিজ এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুই বিশ্বব্যাপী শত শত মৃত্যুর জন্য দায়ী। মশার দেশ বাংলাদেশ। অথচ এখানেই মশা দিবস পালনে নেই তেমন উদ্যোগ।’

শুধুমাত্র কীটনাশক ছিটিয়ে মশা দমন সম্ভব নয়। এজন্য দরকার সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি। মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, মশাবাহিত রোগ বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মশামাহিত রোগের প্রকোপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশ বা প্রতিবেশ ব্যবস্থার কাঠামোই বদলে দিচ্ছে না, বরং মশাবাহিত রোগের বিস্তার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ও ইয়েলো ফিভারের মতো রোগের বিস্তারে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের ধরণ এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’

‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মশার প্রজনন ও জীবনচক্রের গতি বেড়ে যায়। উষ্ণ আবহাওয়ায় মশার ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরের সময় অনেক কমে আসে, ফলে অল্প সময়ে মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে মশার শরীরে থাকা জীবাণু বা ভাইরাসও দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা সংক্রমণের হারকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আগে শীতল আবহাওয়া মশার বৃদ্ধি সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত করতে, কিন্তু এখন উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এমন এলাকায়ও মশা জন্মানো শুরু করেছে যেখানে আগে তারা টিকতে পারত না।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এডিস মশা দুটি ভাইরাসেরই বাহক হওয়ায়, একই সময়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। চিকুনগুনিয়া শনাক্তের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় জটিলতা হতে পারে চিকিৎসাতেও। বছরের প্রথম থেকে কীটতত্ত্ববিদরা এ বিষয়ে সতর্ক করলেও সরকারি কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মশা নিধনে কোনও ধরনের সমন্বিত কার্যক্রম দেখা যায়নি।’

‘যার ফলশ্রুতিতে এ বছর ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি কয়েকগুণ হারে চিকুনগুনিয়াও বেড়ে চলেছে। আগে এটি শহরের সমস্যা হলেও এখন এটি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনে গ্রাম থেকেও রোগী আসছে।’

মশা মারতে রাস্তার পাশে ড্রেনের ভেতর ওষুধ প্রয়োগ করছেন সিটি করপোরেশনের এক কর্মী। ছবি: সালেহীন/টাইমস
মশা মারতে রাস্তার পাশে ড্রেনের ভেতর ওষুধ প্রয়োগ করছেন সিটি করপোরেশনের এক কর্মী। ছবি: সালেহীন/টাইমস

অপরিকল্পিত নগরায়ন, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, প্লাস্টিক বর্জ্য ও জমে থাকা নোংরা পানি এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপরিষ্কার পরিবেশ মশা বহিত রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে বলে মনে করেন ডা. লেলিন চৌধুরীর।

তিনি বলেন, ‘সে কারণে শুধুমাত্র মশা দিবসকে কেন্দ্র করে নয় সারা বছরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য খাত, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে একসাথে কাজ করতে হবে।’

শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘এই মৌসুমে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতা হয়। যার কারণে এডিস মশার জন্ম হয়। এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা—তিনটা রোগই হয়। এই বছর ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়াও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সেখানে জলাবদ্ধতা মূল দায়ী। বর্ষার বাইরেও সারাবছর কিন্তু মশা থাকে। কারণ ভরা মৌসুমেও পানি জমিয়ে রাখায় এডিস মশার জন্ম হয়।’

‘গ্রামীণ এলাকায় পানির ট্যাংক, পুকুর ও নালা, এবং শহুরে এলাকায় ভবনের ছাদ, ফুলের টব, নির্মাণাধীন ভবন ও ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, সবই মশার জন্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মশা থেকে আরও নানা ধরনের রোগ হচ্ছে। আমাদের দেশে সব এখনও আসেনি। মশা নানা রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসছে।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়রে  ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের  সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, ‘মূলত তিন ধরনের মশা দ্বারা বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। ম্যানুফেলিস, এডিস এবং কিউলেক্স। ম্যানুফেলিস দ্বারা ম্যালেরিয়া এবং জ্বর হয়। এডিস দ্বারা ডেঙ্গু চিকনগুনিয়া এবং জিকা হয়। আর কিউলেক্স দ্বারা জাপানিজ এনসেপোলাইটিস হয়। প্রত্যেকটাই বাংলাদেশে প্রবল আকারে দেখা যাচ্ছে।’

‘গত দুই বছরে সারাদেশে ডেঙ্গু পাওয়া যাচ্ছে। এবার চিকনগুনিয়া বাড়ছে। জিকাও পাওয়া যাচ্ছে। জাপানিজ এনসেপোলাইটিসও আছে, কিন্তু আমাদের ওভাবে হয়ত চিহ্নিত করা যায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাঁচার জন্য মশা থেকে বেঁচে থাকাই প্রধান কাজ। নিজের ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি কমিনিউনিটির দায়িত্ব পাড়া-মহল্লা পরিষ্কার রাখা। সরকারের দায়িত্ব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা। ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ ও বাসার চারপাশে যেখানে পানি জমে সেখানে মশা ডিম পাড়ে ও বংশ বৃদ্ধি করে। এজন্য নিজের ঘরবাড়ি, নিজেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ছোট বাচ্চারা যেন হাফপ্যান্ট না পরে, ফুল প্যান্ট পরাতে হবে।  জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত টায়ার, চিপসের প্যাকেটসহ নানান জায়গায় পানি জমে থাকে— এসব সরিয়ে ফেলতে কমিউনিটিকে কাজ করতে হবে। এর বাইরে জমে থাকা ময়লা ও পানি সরিয়ে ফেলতে বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে সরকারকে কাজ করতে হবে ‘

‘একটা দিন সবাইকে সচেতন করার জন্য পালন করা হয়। কিন্তু প্রতিদিনই আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মশার বংশবিস্তার রোধ করতে হবে।’

গত জুন থেকেই দেশে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। যখন পুরো দেশ কাঁপছে ডেঙ্গু জ্বরে, তখনই নতুন করে শঙ্কা জাগাচ্ছে চিকুনগুনিয়া। সব হাসপাতালে ডেঙ্গুর পাশাপাশি কম খরচে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের ব্যবস্থা রাখার তাগিদও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *