ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে যদি একমাত্র একজনই চাইলে বলতে পারতেন, ‘আই অ্যাম দ্য ইন্ডাস্ট্রি’–তিনি হচ্ছেন রাজ্জাক। স্মার্টনেস, লুক, অভিনয় ও বাণিজ্যিক সফলতা সব মিলিয়ে প্রথিতযশা সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী তাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘নায়ক রাজ’। কারণ, তিনি ততদিনে ইন্ডাস্ট্রির রাজা। তার নামে সিনেমা হলে তরুণ-তরুণীদের ঢল নামে। তার বাসায় রাতের পর রাত পার হয়ে যায়–পরিচালক, প্রযোজকদের ভিড় কমে না।
শুধু নিজের ক্যারিয়ার না, অন্যদের ক্যারিয়ারও তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। নতুন পরিচালক-প্রযোজক না শুধু নায়ক, নায়িকাকে এনে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এ জনপ্রিয় সত্তা ‘নায়ক’ কিংবা ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিয়ে বহুল আলোচনা হয়। অথচ তিনি একাধারে একজন সফল পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন। তার এ সত্তা কেন জানি ‘নায়ক রাজ’ উপাধির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট তিনি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তার পরিচালক-প্রযোজক সত্তাকে তুলে আনার প্রচেষ্টায় এ লেখা।
অবিভক্ত ভারতের কলকাতার কালীগঞ্জের নাকতলায় ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্মেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর রাজ্জাক ঠিক করলেন, তিনি বোম্বে চলে যাবেন। পরে মাইগ্রেশন করে খুলনা বর্ডার দিয়ে শিমুলিয়া হয়ে ঢাকায় চলে এলেন রাজ্জাক। তত দিনে তিনি বিয়ে করেছেন (১৯৬২), স্ত্রী রাজলক্ষ্মী ও আট মাসের সন্তান বাপ্পারাজকে সঙ্গে করে ঢাকায় এলেন। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। ঢাকায় এসে শুরুতে অভিনয়ের সুযোগ সেভাবে হয়নি, পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। কাগজের নৌকা, কাগজের বৌ, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন ছবিতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন।

ভালো চরিত্রের জন্য কেউ তখনো তাকে ডাকেনি। তবে তাকে নায়ক হিসেবে প্রথম সুযোগটা দিলেন আরেক কিংবদন্তি জহির রায়হান ‘বেহুলা’-তে। তৎকালীন সুপারস্টার রহমান এক দুর্ঘটনায় পা হারানোর পর দর্শক মনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল কিংবা বাংলাদেশের ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার বিকল্প খুঁজছিল দর্শক–তা যেন ‘বেহুলা’-তে রাজ্জাক-সুচন্দার মধ্যে দর্শক খুঁজে পেল। ছবিটির ব্যবসায়িক সফলতা রাজ্জাককে খুব দ্রুতই দর্শকদের পাশাপাশি পরিচালক-প্রযোজকদের শীর্ষে নিয়ে গেল। সে যে শুরু রাজ্জাক ১৯৯৪ সালে ‘অন্ধবিশ্বাস’ পর্যন্ত একটানা তিন দশক ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ নায়ক হিসেবে তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেন। পুরো ক্যারিয়ারে অবশ্য তিনি অভিনয় করেছেন ৫ শতাধিক ছবিতে।
কিন্তু রাজ্জাক বরাবরই একটু ভিন্ন চিন্তা-চেতনার মানুষ ছিলেন। তার পুরো কর্মজীবনে চলচ্চিত্র ব্যতীত অন্য কোনো কিছুকে প্রধান জীবিকা হিসেবে নেননি। খুলনায় নিজের বাগানবাড়িতে অবকাশে গেলেও সেখানে পরিচালক-প্রযোজকদের নিয়ে যেতেন চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপের জন্য। ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুধু নেবেন না, দেবেন–এমন ভাবনা থেকে তিনি ১৯৭৭ সালে নির্মাণ করেন ‘অনন্ত প্রেম’। ছবিটিতে ববিতার সঙ্গে একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল। যেটির শুটিংয়ের সময় তৎকালীন সিনেমা বিষয়ক পত্রিকাগুলোতে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু ছবিটি ব্যবসা সফল হয়।
পরিচালনা কিংবা প্রযোজনায় রাজ্জাক সবসময় বেছে নিয়েছেন মৌলিক ও সাহিত্যনির্ভর ছবিকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘সৎ ভাই’ ও ‘সন্তান যখন শত্রু’, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের গল্পে ‘চাঁপাডাঙার বউ’, নীহাররঞ্জন গুপ্তের গল্পে ‘উত্তরফ্লাগুনী’সহ অনেক ছবিই নির্মাণ করেন। ছবিগুলো পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজনা করেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে। তিনি ২০টির বেশি ছবি নির্মাণ করেন। তার নির্মিত অন্যান্য ব্যবসাসফল ও নন্দিত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘বদনাম’, ‘অভিযান’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘প্রফেসর’, ‘জ্বীনের বাদশা’, ‘প্রফেসর’, ‘প্রেমশক্তি’, ‘বাবা কেন চাকর’ ইত্যাদি।
অন্যান্য নায়কদের মতো শখের পরিচালক-প্রযোজক ছিলেন না রাজ্জাক। তাহলে কেন শুধু তার নায়ক সত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। এ সত্তাগুলো কেন আলোচিত নয়?

অনন্ত প্রেম ছবিতে ববিতার সঙ্গে রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত
তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও তার আত্মজীবনীর লেখক ছটকু আহমেদ মনে করেন, তিনি তার মধ্যে যে নায়কোচিত ব্যাপারটা ছিল, তাকে তিনি পরিচালক বা প্রযোজক হিসেবে অতিক্রম করতে পারেননি। তার মতে, ‘রাজ্জাক ভাই অনেক বড় একজন পরিচালক ছিলেন, এক কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু তার পরিচালক হিসেবে যে কীর্তি বা যে অবদান সেটা নায়কের উপরে উঠতে পারেনি।’
‘তিনি প্রযোজক হিসেবে কোনোদিন ব্যবসার কথা চিন্তা করেননি। আমাকে যতবারই গল্প শোনার জন্য ডেকেছেন ততবারই বাংলার একদম মাটির গল্প শুনতে চেয়েছেন। কখনই নকল গল্প বানাতে চাননি,’– যোগ করেন ছটকু আহমেদ।
চলচ্চিত্র শিক্ষক ও নির্মাতা ড. মতিন রহমান বলেন, ‘নিজের কাজ নিয়ে উনি নিজে আলোচনা করতে পারেন না। গণমাধ্যমে আপনারা যারা আছেন তারা লিখতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাকে আমরা নায়ক রাজ রাজ্জাক বানায়ে দিছি । হ্যাঁ, ঠিক আছে তিনি অভিনয়শিল্পী হিসেবে এরকম একটা পদবি দাবি করতেই পারে। কিন্তু রাজ্জাক ভাইয়ের চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গও আলোচনা হওয়া উচিত ছিল বা হওয়া এখনো প্রয়োজন আছে। কারণ, উনি যেসব গল্প সাধারণত প্রযোজকরা করতে চাইতো না সে ধরনের গল্পগুলো নিত। এটা একটা সাহসের ব্যাপার, বড় প্রচেষ্টারও ব্যাপার।’
‘যখন তিনি সুভাষ দত্তকে দিয়ে ‘আকাঙ্ক্ষা’ বানাচ্ছেন—এত কঠিন, জটিল একটি বিষয়, তারপরও তিনি ঠিকই সেখানে অর্থায়ন করতেছেন। আবার যদি ‘অনন্ত প্রেম’-র ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ছবিটি এমন একটি গল্পে যার জন্য পরিচালক রাজ্জাকেরর প্রশংসা হওয়াটা জরুরি। আলোচনা হওয়াটা জরুরি।’
‘তারাশঙ্কের উপন্যাস নিয়ে ”চাপাডাঙ্গার বউ” বানিয়েছেন এরকম গল্প বাংলাদেশের কোনো পরিচালক সাহসও করেনি। চাপাডাঙ্গার বউয়ের মতো এত মনস্তাত্ত্বিক একটা গল্পে সিনেমা হবে—এটা কি কেউ ভেবেছিল? কিংবা ‘অভিযান’ যেটা পরবর্তী সময়ে আমরা ‘হাওয়া’ ছবিতে রূপান্তর দেখতে পাচ্ছি— যেটা যুদ্ধ একটা জাহাজের গল্প। এগুলো আলোচনা হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়গুলো জানানোর চেষ্টা করা উচিত,’ বলেন ড. মতিন।
কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘অনন্ত প্রেম’র মূল নেগেটিভ এফডিসি থেকে হারিয়ে গেছে। যার কারণে ছবিটির মূল প্রিন্ট কারো কাছে নেই। শুধু এ ছবি নয়, রাজ্জাক পরিচালক ছবিগুলোর মূল প্রিন্ট সংরক্ষণ করা উচিত বলে মনে করেন এ নির্মাতা-শিক্ষক।

রাজ্জাক অভিনেতা হিসেবে যেমন পরিচ্ছন্ন অভিনেতা ছিলেন, তেমনি নির্মাতা হিসেবেও ছিলেন এমনটা ছিলেন—জানিয়ে চলচ্চিত্র গবেষক, সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষক অনুপম হায়াৎ বলেন, ‘অনন্ত প্রেমের চুম্বন দৃশ্য ওই সময় বাংলাদেশের ছবিতে ভাবা যেত না। আমরাই এর সমালোচনা করে লিখেছিলাম। কিন্তু তিনি তা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন—বাস্তবতার প্রয়োজনেই দৃশ্যটি ছবিটিতে এসেছিল। অথচ তার এ ছবি বা অন্যান্য ছবি নিয়ে আলোচনা না হওয়া দুঃখজনক।’ চলচ্চিত্র সাংবাদিক মাহফুজুর রহমানের মতে, চাষী নজরুল ইসলামের পর সবচেয়ে বেশি সাহিত্যভিত্তিক ছবি নির্মাণ করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক।
‘চাষী নজরুল পেশায় পরিচালক বলে তাকে নিয়ে যথাযথ আলোচনা হয়েছে, কিন্তু নায়করাজের মূল পরিচায় অভিনেতা বলে তার পরিচালনা নিয়ে কথা কম হয়েছে। যে বছর ”বাবা কেন চাকর” মুক্তি পায়, সেই একই বছর নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস থেকে “উত্তরফাল্গুণী” নির্মাণ করেন নায়করাজ,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে গল্পচুরির অভিযোগও কেউ করতে পারেনি। অথচ তার সমসাময়িক পরিচালকরা হরহামেশা গল্পসংকটে ভুগেছেন এবং বোম্বের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। নায়করাজ গল্প সংকটে পড়লে হয় সাহিত্যের কাছে হাত পেতেছেন, নয়তো সাহিত্যিকদের কাছে হাত পেতেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের স্ক্রিপ্ট নিয়েও ছবি করেছেন নায়করাজ। তার এই যে গল্পের প্রতি দুর্বলতা, এটিই তাকে পরিচালক হিসেবে বিশেষত্ব দিয়েছে।’
উদ্ভট গল্পের দেখা যেমন রাজ্জাক নির্মিত ছবিতে দেখা যায়নি, তেমনি দেখা মিলেছে মানবিক গল্পের। মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সৃষ্টিছাড়া, মাত্রাছাড়া, আজগুবি, ধুমধাম ছবি তিনি সযতনে এড়িয়ে গেছেন যখন তিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়েছেন। পরিচালক রাজ্জাকের এই দিকগুলো খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। শুধু অভিনেতা হিসেবে নন, তাকে পরিচালক হিসেবেও মূল্যায়ন করার প্রয়োজন আছে। নইলে যে রাজ্জাককে আমরা পাব, তাতে তিনি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবেন।’