জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অনুমোদন ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে কক্সবাজার সফরের ঘটনায় পাওয়া শোকজ নোটিশের জবাব দিয়েছেন হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, এনসিপির আহ্বায়কের অনুমতি নিয়েই সেদিন ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার এনসিপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব বরাবর লিখিত জবাব পাঠান দলটির এই মুখ্য সংগঠক।
গত মঙ্গলবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে নানান আয়োজন করে সরকার। সেদিন জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বহুল আলোচিত ও আন্দোলনকারীদের প্রতীক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ফলে এই বিশেষ দিনে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের অনুপস্থিতি ও ব্যক্তিগত সফরে কক্সবাজার যাওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তাদের কক্সবাজার ভ্রমণের ছবি ও ভিডিও।
এমন প্রেক্ষাপটে দলের পাঁচ সদস্যকে শোকজ নোটিশ বা কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় এনসিপি। সেখানে বলা হয়, ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থান দিবসে দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চলাকালীন সারজিস আলমসহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা কক্সবাজার সফরে যান, যা পূর্বানুমতি ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। এটি রাজনৈতিকভাবে ‘গুরুত্বহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মুখ্য সংগঠক (উত্তর) সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণ) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা এবং যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং সদস্যসচিব আখতার হোসেনের কাছে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
এই পাঁচজনের মধ্যে প্রথম নোটিশের জবাব দিলেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি জবাবে লিখেছেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানুষ জীবন দিয়েছিল নতুন বাংলাদেশের জন্য। এমন একটি রাষ্ট্র গঠনের আশায়, যেখানে কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না এবং প্রতিটি নাগরিক মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবেন। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যেই এই সরকার গঠিত হয়েছিল। সরকারের উচিত ছিল এমন একটি ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা, যা সেই মানুষগুলোর আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করবে।’
‘কিন্তু আমি এবং অনেকেই ব্যথিত হই, যখন দেখি যে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের সময় সেই মানুষদের কথা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, যারা অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। শহিদ পরিবার, আহত এবং নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই মতামত প্রদানের সুযোগ পাননি, এমনকি অন্তর্ভুক্তির ন্যূনতম সম্মানটুকুও পাননি।’
হাসনাতের দাবি, তিনি ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়ায় এমন কিছু উপাদান দেখেছেন, যা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন, ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে সংবিধান সংস্কারের জন্য জনগণ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর দায়িত্ব অর্পণের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে।
এই বক্তব্যকে সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনার পথে একটি বড় অন্তরায় হিসেবে দেখছেন হাসনাত। তিনি বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে, যা রাষ্ট্রের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনবে এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাবে।’
পাশাপাশি তিনি জানান, আন্দোলনের আহত এবং নেতৃত্বদানকারী অনেককে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটিকে নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘যেখানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ এবং আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থিত থাকার কোনও ইচ্ছা বা প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।’
আর সে কারণেই ঘটনার দিন ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান হাসনাত। তার মতে, এই সময়ে তিনি নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এটি ছিল ‘অসম্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্রের’ প্রতি তার নীরব প্রতিবাদ।
৪ আগস্ট রাতেই ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানাতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাননি বলে চিঠিতে জানিয়েছেন হাসনাত।
তাকে না পেয়ে পরবর্তীতে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারিকে জানান যে, তিনি স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দুই দিনের জন্য ভ্রমণে যাচ্ছেন। যেহেতু নাসীরুদ্দীন সেসময় এনসিপি কার্যালয়েই ছিলেন, তিনি হাসনাতকে আশ্বস্ত করেন যে বিষয়টি নাহিদকে জানাবেন।
হাসনাত বলেন, ‘প্রায় ৩০ মিনিট পর জনাব নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী আমাকে নিশ্চিত করেন যে তিনি আহ্বায়ক মহোদয়কে বিষয়টি জানিয়েছেন এবং আহ্বায়ক মহোদয় এতে সম্মতি প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে আমার সঙ্গে জনাব নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, সস্ত্রীক সারজিস আলম ও তাসনিম জারা- খালেদ সাইফুল্লাহ দম্পতি যুক্ত হন।’
এরপর যা ঘটেছে তাকে অত্যন্ত দুঃখজনক উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি ও ভিডিও করে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মিডিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। কিছু মিডিয়া সেখানে ক্রাইম মুভির মিউজিক জুড়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগসহ সেইসব উপস্থাপন করেছে।’
‘কিছু মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে অপরাধপ্রবণ এবং সন্দেহজনক হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এমনকি গুজব ছড়ানো হয়েছে যে আমরা পিটার হাসের সঙ্গে গোপন বৈঠকে যাচ্ছি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করতে। অথচ তিনি তখন বাংলাদেশেই ছিলেন না।’
হাসনাত আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রবণতা, যেখানে কাউকে টার্গেট করে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে ফেলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার এই সম্মিলিত “ডিমোনাইজেশন” টেকনিক আজকে আমাদের টার্গেট করেছে। ভবিষ্যতে অন্য যে কাউকে করতে পারে।’
এই ঘটনায় তাসনিম জারাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার চালানো হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু গণমাধ্যমের সমন্বিত এই আক্রমণ একটি নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করার সুস্পষ্ট চেষ্টা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ন্যক্কারজনক আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী নারীদের নিরুৎসাহিত করা।’
হাসনাত মনে করেন, তার দলের উচিত ছিল এই গোয়েন্দা সংস্থা ও অসৎ মিডিয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া। তা না করে উল্টো দল তাদের শোকজ করেছে এবং এর মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে উসকে দিয়েছে; মন্তব্য তার।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি কোনো আইনের লঙ্ঘন করেননি দাবি করে হাসনাত বলেন, ‘এমন বিধিবহির্ভূত (arbitrary) শোকজ দেওয়া এবং অতি উৎসাহী হয়ে তা মিডিয়ায় প্রকাশ করা কতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক হয়েছে, সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাববার অনুরোধ করব।’
এনসিপির প্রতি নিজের অঙ্গীকারের কথা জানিয়ে অবস্থান ব্যাখ্যার সুযোগের জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন তিনি।