ভারত মহাসাগরের ঢেউয়ের কাঁধে চড়ে আসা ভেজা হাওয়ার ঝাঁপটা প্রতিদিন লাগে গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের অদূরে শ্রীলংকার ইতিহাসের স্মারক হয়ে থাকা গল দূর্গের দেয়ালে। দুর্গ ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস ছড়িয়ে পড়ে মাঠজুড়ে। এ যেন অলিখিত এক নিয়ম, যার বাত্যয় ঘটার সুযোগ খুব একটা নেই। ঠিক তেমনি গলে বাংলাদেশের টেস্ট মানেই মুশফিকুর রহিমের চওড়া ব্যাট আর বড় রান। প্রকৃতির এক অমোঘ খেয়ালের সাথে এক পৃষ্ঠায় মুশফিককে বসানোতে অত্যুক্তি মনে হচ্ছে? এই মাঠে মুশফিকের ব্যাটিং পরিসংখ্যান, তার ইমপ্যাক্ট, খেলার ধরনের দিকে তাকালে অবশ্য সেসব স্বাভাবিকই মনে হবে।
ষোড়শ শতাব্দীতে ব্যবসা করতে শ্রীলংকায় ঘাঁটি গড়া পর্তুগিজদের বানানো গল দুর্গের দখল সপ্তদশ শতাব্দীতে নেয় ডাচরা। এরপর থেকে শ্রীলংকার ইতিহাসের মাইলস্টোন হয়ে আছে সেই দুর্গ; যা কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গোটা শহর। এখনও হয়ে আছে একাল আর সেকালের সেতুবন্ধন। লংকানদের কাছে এই দুর্গ কিংবা গল শহর যতটা আপন, মুশফিকের কাছেও তেমনই স্পেশাল।

২০১৩ সালে প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট দৃষ্টিনন্দন এই মাঠেই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন মুশফিক। এরপর অবশ্য আরো দুইবার ২০০ পেরিয়েছেন তিনি, কিন্তু প্রথম অর্জনের উচ্ছ্বাস তো ছাপিয়ে যাওয়ার কথা সমুদ্রের বড় ঢেউগুলোকেও। সেই আনন্দে যে ভাটা পড়েনি এতটুকুও, প্রমাণ মিলল এক যুগ পরে এসেও।
এবারের গল টেস্টে সেঞ্চুরি করে সংবাদ সম্মেলনে এসে মুশফিকের কন্ঠে ঝরল দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হওয়ার তৃপ্তি, তবে তার চেয়ে বেশি থাকল পরের প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ়তা। মঙ্গলবার মুশফিক বলেন, ‘গল স্পেশাল বলতে এখানে আপনি যখন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করবেন এটা সব সময়ই স্পেশাল। আমাদের একটি জেনারেশনকে স্টেপ বাই স্টেপ উপরে নিয়ে যেতে হবে। ওটার পর নিশ্চিত ওরা বিশ্বাস করতে পেরেছে যে টেস্টে দুইশত করা যায়। তাই অবশ্যই এখন কেউ আড়াইশত করবে তিনশত করবে। সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।’

গলে আঠারো শতকের শেষদিকে ঘোড়দৌড় হতো। নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের মতো মুশফিক গলের এই মাঠেও লম্বা রেসের ঘোড়া। এখন পর্যন্ত এই মাঠে তিন টেস্টের চার ইনিংসে ব্যাট করেছেন। এতেই একটা ডাবল সেঞ্চুরি, একটি ফিফটি ও দুই সেঞ্চুরি হয়ে গেছে তার। নিজের করে নেয়া এই মাঠে মুশফিকের ব্যাট থেকে এসেছে ৪৭৮ রান, ব্যাটিং গড়টা অবিশ্বাস্য ১৫৯.৩৩। বিদেশি ব্যাটারদের মধ্যে এই মাঠের তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার এখন মুশফিক। তার চেয়ে অল্প ব্যবধানে এগিয়ে আছেন কেবল অস্ট্রেলিয়ান উসমান খাওয়াজা (৪৯০ রান) ও সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক ইউনুস খান (৪৯৭ রান)। অবশ্য এই দুজনকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে মুশফিকের সামনে।
২০১৩ সালে এই মাঠে তার প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, ড্র হওয়া সেই ম্যাচে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৬৩৮ রানের সংগ্রহ পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই রেকর্ড টিকে আছে এখনও। এরপর ২০১৭ সালে গলে নিজের দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংসে আসে ৮৫ আর ৩৪ রানের ইনিংস। আর এবার আট বছর পর গলে ফিরলেন মুশফিক রাজার মতোই। টেস্ট ব্যাটিংয়ের টাটকা উদাহরণ দেখিয়ে ১৭৬ বলে করলেন নিজের ১২-তম সেঞ্চুরি। বাউন্ডারি ছিল সাকুল্যে পাঁচটি। প্রথম দিন ১০৫ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়া মুশফিক দ্বিতীয় দিন বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাট করছিলেন ১৫৯ রানে। যেভাবে নিজের ইনিংসটা গড়েছেন, একই ধারাবাহিকতায় খেলতে থাকলে এই মাঠে দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটা হয়তো পেয়েও যেতে পারেন।

অবশ্য সেঞ্চুরি-ডাবল সেঞ্চুরির তৃপ্তির চেয়ে এই ইনিংসটা মুশফিককে স্বস্তিই দেবে বেশি। পাকিস্তানে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরির পর মাঝে টানা ১৩ ইনিংসে ছিল না কোনো ফিফটি। গল টেস্টের আগের চার ইনিংসে আউট হয়েছেন সিংগেল ডিজিটে। দলে তার জায়গা নিয়েও একটা প্রশ্ন উঠেছিল। সেসব প্রশ্নের উত্তর মুশফিক আপাতত দিয়ে ফেলেছেন। ‘ফুরিয়ে যাননি’ বলে একটা বার্তা দেয়ার ছিল, সেটাও মুশফিকের ব্যাট থেকে পেয়ে গেছেন সবাই।
দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৯৭টা টেস্ট খেলেছেন মুশফিক, রানও তার ব্যাট থেকেই সবচেয়ে বেশি এসেছে। মুশফিকের এই নিবেদনের সাক্ষী তার অভিষেকের রংচটা টেস্ট ক্যাপটা। লেগেছে গলের দুর্গ ছুঁয়ে আসা ভারত মহাসাগরের উত্তাল হাওয়া। সাথে লেগেছে কড়া গলের কড়া রোদও, নইলে বোধহয় মুশফিকের টেস্ট ক্যাপের রঙ হারাতো আরেকটু দেরিতে।