একটি রায়। একটি মাত্র রায় দিয়েই গণতন্ত্রের জমিনে বপন করা হয়েছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার বিষবৃক্ষ।
দেশের মানুষের মনে এখনো জ্বলমান—২০১০ সালের দারুণ দহনবেলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছিলেন, সেটিই হয়ে ওঠে দেড় দশক ধরে চলা গণতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসনের আইনগত সূচনাবিন্দু।
বিচারপতি খায়রুলের রায়ের ভাষ্য ছিল অনেকটা এরকম, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া বিধান।’ কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এই ব্যবস্থা ছিল হলো ১৯৯০ এ সেলিম-দেলোয়ার-নূর হোসেনের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার এরশাদকে উৎখাতের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত ফসল।
খায়রুল হকের সেই রায় শুধু ইতিহাসবিচ্যুতি নয়, বরং ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে উপহার দেওয়া এক জাদুকাঠি, যার মন্ত্রবলে হিরকের রাণী একে একে তিনটি প্রহসনের নির্বাচন করেন।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্বাচনের একটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না, ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার’ সেটি নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু ভোট হয়নি। আবার আরেকটি ‘নিশিরাতের নির্বাচনে’ ভোটের আগেই ভর্তি হয়ে যায় ব্যালট। আর শেষটিতে বিরোধী দল বলে কোনো বস্তুই ছিল না, ‘ডামি নির্বাচন’ ছিল আসলে ‘আমরা আর মামুরা’।
কোনো রায়ের পেছনে যখন রাজনৈতিক মতলব কাজ করে, তা বিচারব্যবস্থার জন্য তো বটেই, আসলে তা পুরো রাষ্ট্রেরই মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। সেই ভাঙনের জের এখনও চলমান।
সে সময় বিচারপতি খায়রুল তার রায়ের পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একাধিক সরকারি বাসভবন, বিলাসবহুল গাড়ি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা—যা ‘নীতিগত অসঙ্গতি’র নিদর্শন হিসেবে ব্যাপক সমালোচিত। অবসরের পরে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে তার নিয়োগ ছিল সরাসরি সরকারের গোপন আঁতাত, যা আঘাত করেছে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার মূলে।
আরও দুর্ভাগ্যজনক, এই সাবেক প্রধান বিচারপতি একাধিকবার রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে অপমান করেছেন নিজের পদটিকে। বিচারপতির আসন কেবল আদালতের নয়, বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার প্রতীক। খায়রুল হক সে আস্থাকে খুন করেছেন। রাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি এমন এক ব্যতিক্রম, যিনি নিজ হাতে আইনগত কাঠামো নির্মাণের বদলে তা ভেঙে দিয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র তার প্রতীকী ক্ষমতার চর্চা করে বিচারব্যবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। সেক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে, তবে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভকে ভেতর থেকে করবে ভঙ্গুর।
আর জাতি যখন ফ্যাসিবাদী শাসনের গুম, খুন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত অন্ধকার অধ্যায় পার করেছে, তখন এর ‘শুরুর শুরু’কে মনে রাখা ভাল।
আদালতের একটি ভুল বা উদ্দেশ্যমূলক রায় কখনো কখনো একটি জাতিকে কয়েক প্রজন্ম পিছিয়ে দিতে পারে। আর বিচারপতি খায়রুলের সেই ‘অপরায়’ সর্বোচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া এক জগদ্দল পাথর, যার সুনিপুণ কারিগর ছিলেন বিচারপতি নিজেই।
ইতিহাসই এখন বিচার করবে বিচারপতির। আর নিশ্চয়ই ‘একদিন আগামীর ভোর’। সকলে সেই সুদিনের অপেক্ষায়।