চলমান মৌসুমি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে চার জেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফেনী, নোয়াখালী ও কক্সবাজার জেলার অন্তত তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার টাইমস অব বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন:
ফেনী: ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে জেলার প্রায় ৩২ হাজার পরিবার। টানা বৃষ্টি ও ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর ২১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম।
বুধবার রাত পর্যন্ত ছাগলনাইয়া উপজেলার নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাত হাজার মানুষ। এদিন সন্ধ্যার পর থেকে ছাগলনাইয়ার মাটিয়াগোধা, দক্ষিণ সতর, উত্তর সতর, লক্ষ্মীপুর, নিচিন্তা ও কাশিপুরসহ ১০টির বেশি গ্রামে প্রবল স্রোতে পানি ঢুকে পড়ে। রাস্তা-ঘাট ডুবে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। বিপাকে পড়েছেন আরও অন্তত ২০ হাজার মানুষ।
দুই উপজেলার কিছু এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি, মিটার ও ট্রান্সফরমার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে প্রায় ৩১ হাজার ২০০ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখেছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ।
ফুলগাজী পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম মো. হাবিবুর রহমান জানান, স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে উপজেলার ৩০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। এ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৩৮ হাজার।
পরশুরাম পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম মো. সোহেল আকতার জানান, এ উপজেলায় ৩৩ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৬০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সংযোগ দেওয়া হবে। তবে বিদ্যুতের বিভিন্ন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সহসাই সংযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, পরশুরামের ১২টি এবং ফুলগাজীর ৯টিসহ মোট ২১টি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে। এর মধ্যে মুহুরী নদীর ১১টি, কহুয়া নদীর ৬টি এবং সিলোনিয়া নদীর ৪টি অংশে বাঁধ ভাঙনে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
ফেনী আবহাওয়া অফিস জানায়, ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত) জেলায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম জানান, বানভাসী মানুষদের জন্য শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নোয়াখালী: এ জেলায় ঘরছাড়া ৬৩ হাজার মানুষ, পানিবন্দী লক্ষাধিক। কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।
নোয়াখালী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলার সদর, সুবর্ণচর, হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জসহ অধিকাংশ উপজেলার নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ, বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন। ১৯ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৬৩হাজার ৮৬০ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিভিন্ন যায়গায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালীর প্রধান নদী মেঘনা ও এর শাখা নদীগুলোর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে নিচু এলাকার বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা সদরের মাইজদী, সোনাপুরসহ শহরাঞ্চলের অনেক স্থানেও জলাবদ্ধতার ও পানিবন্দির কারণে গ্রামীণ এলাকায় চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। রোপা আমন ধান এবং সবজির ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেক পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। শুকনো খাবার, পানীয় জল, এবং প্রয়োজনীয় ওষধু সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নোয়াখালীতে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ, স্থানীয়দের ক্ষোভ
স্থানীয়দের মতে, নোয়াখালীর জলাবদ্ধতার জন্য বেশ কয়েকটি বিষয় সরাসরি দায়ী। এর মধ্যে অন্যতম হলো অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুরনো ও অপ্রতুল। বেশিরভাগ ড্রেনই সরু এবং ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি উপচে জনপথে চলে আসে।
নোয়াখালী পৌরসভার পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও, তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এলাকাবাসী দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায়, প্রতিবছর বর্ষায় জলাবদ্ধতার অভিশাপ নোয়াখালীবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকবে।
কক্সবাজার: বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার এসব গ্রামের অধিকাংশ এলাকার বাড়িঘর বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অফিস।
অব্যাহত বর্ষণে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের কলাতলী প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে সড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
টানা বৃষ্টির কারণে পর্যটন এলাকা ছাড়াও জেলার উখিয়া, টেকনাফ ও চকরিয়াসহ নয় উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রামের অধিকাংশ এলাকা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক-উপসড়কে পানি উঠে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। সাগর উত্তাল রয়েছে। পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার কমপক্ষে ৫০টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে উখিয়া উপজেলার ১০ এবং টেকনাফ উপজেলার ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া উখিয়ার তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টির তথ্য মিলেছে।
টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য মতে, টেকনাফে ভারী বৃষ্টিপাতে কমপক্ষে ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৫০ হাজার পরিবার বন্দি হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৮টি গ্রাম, হ্নীলা ইউনিয়নে ৭টি গ্রাম, টেকনাফ পৌরসভার ৫টি গ্রাম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম, সাবরাং ইউনিয়নে ৭টি গ্রাম, বাহারছড়া ইউনিয়নে ৮টি গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
সাতক্ষীরা: টানা বৃষ্টিতেহ সাতক্ষীরার শহরসহ নিন্মাঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। সদর, তালা, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে আমন বীজতলা, আউশ ধান ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে অসংখ্য মৎস্য ঘের। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেননি মৎস্য ও কৃষি বিভাগ। এ ছাড়া শহর ও আশপাশের প্রায় শতাধিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম, বিশেষ করে চলমান এইচএসসি ও অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, গত ১০ দিনে সাতক্ষীরায় ৩৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যার মধ্যে বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ মিলিমিটার।
বান্দরবান: পাহাড় ধসের আশঙ্কায় বান্দরবানের লামা এলাকার পর্যটন কেন্দ্রগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বলেছে স্থানীয় প্রশাসন।
বৃহষ্পতিবার ১০ জুলাই সকালে অনুষ্ঠিত উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে গত মাসেও প্রতিকুল আবহাওয়ার কারণে উপজেলার মিরিঞ্জা ও সুখিয়া-দুখিয়াসহ বিভিন্ন পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত অবকাশ কেন্দ্র এবং রিসোর্টগুলো বন্ধ রেখেছিল।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্ষায় পাহাড়ি এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় ঝুঁকি এড়াতে এমন ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে পর্যটন কেন্দ্রগুলো আবার খুলে দেয়া হবে।