জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলাগুলোর তদন্তে নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে পুলিশ। দশ মাস হতে চললেও ছয়শ হত্যা মামলার একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেছেন: তদন্ত কর্মকর্তারা সবকিছু যাচাই করছেন এবং প্রতিটি মামলার ওপর সার্বক্ষণিক তদারকি চলছে।
যাচাই-বাছাই ও তদারকির ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, ‘অনেক বাদী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিরীহ ব্যক্তিকে আসামি করেছেন। কেউ কেউ আদালতে নারাজি দিচ্ছেন, টাকা নিচ্ছেন। তবে আমরা নিশ্চিত করছি যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি না পায়।’

তিনি জানান, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ১৫শর মতো মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬০০টি হত্যা মামলা।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এরইমধ্যে জমা পড়েছে সাড়ে তিনশর বেশি অভিযোগ। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, থানার তদন্ত ও ট্রাইব্যুনালের বিচার– এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে কীভাবে সমন্বয় হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন: আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ৩৫০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে গণহারে মানুষ হত্যা, গুম, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ রয়েছে। এসব অপরাধের বিচার থানা বা দণ্ডবিধির আওতায় নয়, ট্রাইব্যুনালের আওতায় পড়ে।
‘বিচারের দুটি ধারা এখানে সমান্তরালভাবে চলতে পারে– একটি হচ্ছে দণ্ডবিধি অনুসারে ফৌজদারি মামলা, আরেকটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে বিচার। তবে, উভয় জায়গায় আসামিরা এক হবে না। ট্রাইব্যুনালের বিচার কাঠামো অনুসারে আলাদা অপরাধ কাঠামোতে বিচার হবে। একই ঘটনা থেকে পৃথক চরিত্রের দুটি বিচারিক ধারা তৈরি হতে পারে,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশ বলছে, থানায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্তের পথে বড় বাধা সুসংগিঠত তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যর অভাব। অনেক মামলায় অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার গড়মিল আছে, মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে মামলার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাদী, বিভ্রান্তিকর এজাহার এবং পুলিশি লজিস্টিক ঘাটতিও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার রফিকুল ইসলাম টাইমস অব বাংলাদেশকে জানান, জুলাই আন্দোলনে দায়ের হওয়া হত্যা মামলার একটিতেও এখনও চার্জশিট হয়নি। অন্য ধারায় দায়ের হওয়া ২০টির মতো মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
ময়নাতদন্ত না হওয়ার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর অভাব, তদন্ত কর্মকর্তার সীমাবদ্ধতা এবং বাদীর অনুপস্থিতি ও বক্তব্যে পরিবর্তন ছাড়াও নানা কারণে তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাভারের দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায়।
৫ আগস্ট সাভার থানার সামনে নিহত হন মাদ্রাসাছাত্র হাসিবুর রহমান। তার চাচা মোঃ ফুয়াদ হোসেন ৭ আগস্ট মামলা করেন, যাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা এবং আরও দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফজলুর রহমান পরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, যে কারণে তদন্ত পিছিয়ে যায়।
বাদী ফুয়াদ হোসেন বলেন, ‘লাশের কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি। আমি কেরানীগঞ্জ থেকে দুইদিন থানায় গিয়েছি, কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তা যে মারা গেছেন সেটাও আমি জানতাম না।’
একই দিন সাভারের কলেজ রোডে গুলিতে নিহত হন মারুফ মিঠু। তার বাবা শাহজাহান মামলা করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে বর্তমানে দায়িত্বে আছেন এসআই অটলবিহারী বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘বাদী বেশ কয়েকজন আসামির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে হলফনামা দিয়েছেন। ফলে তদন্তকাজে আমরা দ্বিধায় পড়ছি।’

অনেক মামলায় বাদীই ময়নাতদন্তে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
রাজধানীর শাহজাদপুরে নিহত শিক্ষার্থী নাঈমুর রহমানের বাবা গুলশান থানায় ৬৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করলেও তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক নুরুল ইসলাম জানান, ‘বাদী ময়নাতদন্ত চাননি। অথচ ময়নাতদন্ত ছাড়া চার্জশিট দিলে মামলাটির ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়।’
দিনাজপুরে নিহত কলেজছাত্র রবিউল ইসলামের পরিবারও ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি। পিবিআই পরিদর্শক প্রদীপ কুমার রায় বলেন: রবিউলের পরিবার লাশের ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি। ফলে রিপোর্ট তৈরি সম্ভব হয়নি। এখন নির্দেশনা অনুযায়ী চার্জশিট প্রস্তুত করতে হবে।
ঢাকার মিরপুরে নিহত যুবদলকর্মী মহিউদ্দিনের ঘটনায়ও একই চিত্র। পরিবারের বাধায় লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, ‘তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যতটুকু সম্ভব, আমরা কাজ করছি। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণই প্রধান হাতিয়ার।’
কোনো কোনো মামলায় দেখা গেছে, পূর্ব শত্রুতার জেরে আসামি বানানো হয়েছে নির্দোষ ব্যক্তিদের।
সাভার থানার এসআই মতিউর রহমান জানান, ‘এক মাদ্রাসাছাত্র নিহতের মামলায় বাদী সিংগাইরের এক ব্যক্তিকে আসামি করেছেন। তদন্তে জানা গেছে, তাদের মধ্যে জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল।’
জটিলতা আরও বেড়েছে যখন একই ঘটনায় দুটি থানায় আলাদা মামলা হয়েছে। যেমন আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় শরিফুল ইসলাম সজলের করা দুটি মামলা। দুই মামলায় সময় প্রায় এক হলেও স্থান আলাদা দেখানো হয়েছে। আবার বাদী তদন্তকারীদের এড়িয়ে চলছেন।
যাত্রাবাড়ি থানায় নিহত পিকআপচালক শাহীন হত্যা মামলায় ৮৭ জনের নামসহ ২ হাজার অজ্ঞাত আসামির কথা বলা হয়েছে। অথচ শাহীনের স্ত্রী স্বপ্না বেগম জানান, ‘আমি মাত্র চারজনের নাম দিয়েছিলাম। এত লোকের নাম মামলায় কিভাবে এলো, বুঝতে পারছি না।’
একইভাবে, ৪ আগস্ট ঝিগাতলা মোড়ে নিহত স্কুলছাত্র মোতালিব নিহতের মামলায় তার বাবা বাদী হলেও পরে আরেকজন অপরিচিত ব্যক্তি আদালতে নতুন করে অভিযোগ করেন।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও কদমতলী থানায় একই ঘটনার দুটি আলাদা মামলা দায়ের হয়েছে রায়েরবাগে মো. মেহেদী হাসান প্রান্ত হত্যার ঘটনায়।

মামলার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কিশোরগঞ্জের দুলাল রবি দাশের মৃত্যুর ঘটনায়। মৃত্যুসনদে স্পষ্টভাবে লেখা যে তিনি স্ট্রোকে মারা গেছেন, কিন্তু অভিযোগে বলা হয় তিনি আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত হন। কিশোরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলাও দায়ের হয়।
এসব মামলা তদন্তে জটিলতার মুখোমুখি হওয়ায় অনেক তদন্ত কর্মকর্তা মামলা থেকে সরে যেতে বদলির আবেদন করছেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস. এন. মো. নজরুল ইসলাম অবশ্য টাইমস অব বাংলাদেশের কাছে এমন বিষয় নাকচ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় কাজের চাপ বেশি এবং বসবাস ব্যয়বহুল হওয়ায় কেউ কেউ বদলি হতে চেয়েছিলেন। তবে এখন বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আছে।’
এখন পর্যন্ত এসব মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তি কারাগারে আছেন। পুলিশের ২৮ জন কর্মকর্তা বন্দী। বেশিরভাগ মামলাতেই প্রধান অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।