‘টালমাটাল’ অন্তর্বর্তী সরকার

4 Min Read
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ছবি: পিআইডি

অব্যাহত অস্থিরতা সামাল দিতে না পেরে রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা চেয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এক বছর আগে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ফের দেশের নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে পারে- এই শঙ্কায় সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সম্প্রতি গোপালগঞ্জে রক্তাক্ত সংঘর্ষ, উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত এবং সচিবালয়ে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ- এই ঘটনাগুলো সরকারকে পুরোপুরি অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। এতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতারা।

তাদের মতে, ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার মুখে সরকার রাজনৈতিক চাপে পড়েছে এবং এ অবস্থায় সব দলের সহায়তা ছাড়া তাদের সামনে তেমন কোনো বিকল্প নেই।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার ‘একনায়কত্বের অবসান’ এবং ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের’ প্রতিশ্রুতি দিলেও এক বছরে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, শাসন অভিজ্ঞতার অভাব ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতাই মূলত এই ব্যর্থতার কারণ।

পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ২০টির বেশি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মঙ্গলবার রাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। বুধবার আরও ১৩টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, আমরা সাড়া দিয়েছি। আমরা সরকারকে সহায়তার ইচ্ছা প্রকাশ করেছি, তবে সতর্ক করে দিয়েছি যে অরাজনৈতিক সরকার সংকট আরও বাড়াবে। আমরা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আবারও জানিয়েছি।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘একটি পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদ উৎখাত করেছি, তা আবার মাথাচাড়া দিতে দেব না।’

ইসলামী আন্দোলনের গাজী আতাউর রহমান জানান, প্রধান উপদেষ্টা ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ’ পুনরুত্থান রোধে সর্বমহলের সহায়তা চেয়েছেন।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মনজু, বাসদের বজলুর রশীদ ফিরোজ, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স, খেলাফত মজলিসের আহমদ আবদুল কাদের এবং জেএসডির তানিয়া রব।

বৈঠকে গোপালগঞ্জের এনসিপি সভায় সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনাটি গুরুত্ব পায়। আলোচনায় এনসিপি এবং সরকারের ভূমিকাই সমালোচনার মুখে পড়ে।

বিশেষ করে এনসিপি নেতাদের সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় গোপালগঞ্জ ত্যাগ, পরদিন ফরিদপুরে বিজিবি পাহারায় মিছিল এবং চট্টগ্রামের চকরিয়ায় বিএনপি ও এনসিপি কর্মীদের সংঘর্ষ নিয়েও উদ্বেগ জানানো হয়।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, যদি এমন সংঘাত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নির্বাচন আয়োজন- দুটোই কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সরকার এখন জাতীয় ঐক্য এবং রাজনৈতিক সমন্বয়ের ওপর জোর দিচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণে নিয়োজিত যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিধ্বস্ত হয়ে বহু প্রাণহানি ও ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর সরকার আরও চাপে পড়ে।

ঘটনার দিন দু’জন উপদেষ্টাকে শিক্ষার্থীরা নয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে, পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এটি বিরল ও প্রতীকী এক ঘটনা হয়ে উঠে।

সেদিনই সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার জন্ম দেয়। বিক্ষোভ বরিশাল, যশোর, কুমিল্লা এবং সিরাজগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে সিপিবি, বাসদ এবং জেএসডির নেতারা প্রতিবাদ জানিয়ে ওয়াকআউট করেন।

সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘এই সরকার একনায়ক শাসনের মতো আচরণ করছে, আমরা নীরব থাকতে পারি না।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার অভাবই তাদের ভাবমূর্তি ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে।

এক বছর পার হলেও সরকার অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জনসন্তুষ্টির সংকট কাটাতে পারেনি।

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগকে অনেকে কৌশলগত মনে করলেও, সরকার আদৌ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারবে কিনা- সেটি এখনো অনিশ্চিত।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *