চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের ৯৮.৫% ঢাকার

টাইমস রিপোর্ট
5 Min Read
এডিস মশার মাধ্যমেই ছড়ায় চিকুনগুনিয়া। ছবি: সংগৃহীত

দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে চিকুনগুনিয়া। এর প্রভাবে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের ৯৮.৫ শতাংশ রোগী ঢাকার বাসিন্দা বলে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৯৬ শতাংশ ভুগেছেন জয়েন্ট পেইনে। দীর্ঘমেয়াদী গিঁট ব্যথা, যা বহুদিন স্থায়ী হয় এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডাক্তারের পরামর্শ ও সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। পাশাপাশি পুষ্টিকর ও ইলেক্ট্রোলাইটযুক্ত খাবার খেতে হবে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, চলতি জুন মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে রাজধানীতে জ্বর ও উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে আসা ১৭১ জন রোগীর মধ্যে ১৪০ জনের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৮২ শতাংশ।

২০১৭ সালে ঢাকায় প্রথম বড় আকারে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আইসিডিডিআরের হিসাবে সে বছর অন্তত ১৩ হাজার রোগী শনাক্ত হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি লাখ ছাড়িয়েছিল বলে ধারণা গবেষকদের।

২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আইসিডিডিআরবি, কিল ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাজ্য) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ৩৯৪ জন উপসর্গধারী রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে, যাদের মধ্যে ১৩৮ জনের (৩৫ শতাংশ) রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এই ১৩৮ জনের মধ্যে ৯৮.৫ শতাংশ রোগী ঢাকার বাসিন্দা, যার মধ্যে ৫২ শতাংশ রোগী ঢাকা দক্ষিণে এবং ৪৬ শতাংশ ঢাকা উত্তরের। বাকি দুজন নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের। আক্রান্ত এসব রোগীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ পুরুষ ও ৩৫ শতাংশ নারী। এমনকি আক্রান্ত প্রায় ৮৩ শতাংশ রোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি।

জরিপে দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৯৬ শতাংশ ভুগেছেন জয়েন্ট পেইনে। এ ছাড়া, ২৯.৪ শতাংশ রোগী ক্লান্তিতে ভুগেছেন, ১৯ শতাংশ রোগীর অস্থিসন্ধি ফুলে গিয়েছে। এমনকি আক্রান্ত প্রায় ৮১ শতাংশ রোগীর ২৮ দিন পরও উপসর্গ বিদ্যমান ছিল বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

গবেষণা কার্যক্রমের প্রধান সদস্য ও আইসিডিডিআরবির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, ‘এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আমরা নিয়মিতভাবে পজিটিভ কেস পাচ্ছি। সামনের মাসগুলোতে, বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে চিকুনগুনিয়া বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঈদে মানুষের দেশব্যাপী চলাচলের ফলে এটি সারা দেশে ছড়াতে পারে।’

গবেষকরা বলছেন, এই রোগের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো- দীর্ঘমেয়াদী গিঁট ব্যথা, যা বহুদিন স্থায়ী হয় এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস করে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকত হবে। এ সময়ে রোগীকে পুষ্টিকর ও ইলেক্ট্রোলাইটযুক্ত খাবার (কলা, তরমুজ, পালংশাক, সবুজশাক) খেতে হবে।’

‘ঝুঁকি কমাতে অবশ্যই মশা নিধন করতে হবে। আর শিশু ও বৃদ্ধরা ঘুমালে মশারি টাঙানো লাগবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গুর উপসর্গ অনেকটাই কাছাকাছি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও প্রায় একই। তাই সবাইকে পরীক্ষা করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সাধারণত ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস বেশি কার্যকর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কনসালটেন্টরা রোগীর উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় করতে পারেন।’

মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বরাদ্দ রাখে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস আসে। এরপরও মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও পরিবর্তন দেখা যায় না। বরাবরের মতো এবারও নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন।

এ বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এডিস মশার বিস্তার রোধে তাৎক্ষণিক ফলাফল পেতে দৈনিক দ্বিগুণ হারে কীটনাশক ছিটানোর ঘোষণা দিয়েছে। ডিএসসিসি এলাকায় দৈনিক এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমে (ফগার মেশিন ব্যবহার করে) বর্তমানের বরাদ্দ ৩০ লিটারের পরিবর্তে ৬০ লিটার কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এছাড়া মশককর্মীদের সকাল ও বিকালের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং কীটনাশক সঠিক অনুপাতে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত যাচাই করবে সংস্থাটি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি থেকে আরও জানানো হয়, বাড়ির ভেতর, আঙিনা ও ছাদের জমে থাকা পানির উৎসগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক এবং সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয়েছে অঞ্চলভিত্তিক ডেঙ্গু মনিটরিং টিম। এছাড়া মশক নিধনে জনবল ঘাটতি পূরণে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর বাইরে জনসচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ডিএনসিসি থেকে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ইউনিট চালুর জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রশাসক। নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদনে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু করা হবে এবং এক সপ্তাহ পরও লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *