বাংলাদেশের ১৩তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি এমন একটি পারিবারিক ঐতিহ্য বহন করেন, যার শিকড় দেশের রক্তাক্ত রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
তার বাবা কাজী আবদুল আউয়াল ছিলেন ১৯৭৫ সালের জেলহত্যার সময় কারা অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি)। ওই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতিতে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
ওই বছরের ৩ নভেম্বর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার কয়েক মাস পর মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের চার গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী–ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ কারা কর্মকর্তা হিসেবে কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন (এফআইআর) দাখিল করেন ও পরে এ মামলার প্রধান বাদীও হন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর মামলাটি পুনরায় চালু করা হয়।
কাজী হাবিবুল আউয়াল তার বাবার পথ অনুসরণ করে সরকারি চাকরিতে যুক্ত হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চপদস্থ আমলা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তাকে নির্বাচনী রাজনীতির ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঠেলে দেয়।
প্রবীণ এই আমলা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সচিব ও সিনিয়র সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। প্রক্রিয়াগত শৃঙ্খলা ও আইনি ব্যাখ্যার প্রতি তার প্রবল ঝোঁক থাকায় তাকে প্রায়শই একজন ‘টেকনোক্র্যাট’ হিসেবে দেখা হত। আইন ও রাজনীতির মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তার মেয়াদ হয়ে ওঠে বিতর্কের এক কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে ২০২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই এই বিতর্ক।
ওই নির্বাচন বিরোধী দলগুলোর বর্জন, ভোটার দমননীতি ও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে ক্ষুব্ধ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও নাগরিক সমাজ। এসব বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন হাবিবুল আউয়াল।
বুধবার তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয় বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
ডিবি কর্মকর্তারা জানান, হাবিবুল আউয়ালের গ্রেপ্তার বিএনপির করা করা একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। মামলাটি শেরেবাংলা নগর থানায় করা হয়। এ মামলায় ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন তিন সাবেক সিইসি।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ের নির্বাচন কারচুপি ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন দমন অভিযানে তারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, এবং পুলিশের ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সাবেক প্রধান। নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে রয়েছেন-কাজী হাবিবুল আউয়াল (২০২৪), কেএম নূরুল হুদা (২০১৮), কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ (২০১৪), রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।
এর আগে সাবেক সিইসি একেএম নূরুল হুদাও গ্রেপ্তার হন। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অধ্যায় শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় অতীতের ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সরকার।