‘আমরা কারফিউ ভাঙার ঘোষণা দিলাম’

টাইমস রিপোর্ট
8 Min Read
‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক/টাইমস

‘৪ আগস্ট পরদিনের কর্মসূচি ঘোষণার পর মাঠের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। যখন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, তখনো প্রাণহানির খবর সেভাবে আসেনি। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে সারা দিন সংঘর্ষ চললেও প্রাণহানি ছিল কম। কিন্তু বিকেল হতে না হতেই পুলিশ ও বিজিবি গুলি করতে শুরু করে। প্রাণহানির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। মনে হলো বর্তমান পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হবে, তত বেশি লাশ পড়বে, আওয়ামী লীগও আরও বেশি সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় লোক জড়ো করছে,’  চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ দিনগুলোর কথা এভাবে স্মৃতিচারণায় বলেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক,  বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক গ্রন্থে অভ্যুত্থানের দিনলিপি তুলে ধরেছেন সজিব ভূঁইয়া। গত মার্চে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিত বইয়ে ‘লংমার্চ: পরশু নয়, আগামীকালই’ প্রথম পর্বে তিনি তুলে ধরেন উত্তাল দিনগুলোর কথা।

জুলাই অভ্যুত্থানের মহানায়ক আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। ছবি: ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘৪ আগস্টে যে কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল, সেটা তারা ততক্ষণে ৫ আগস্টে সরিয়ে নিয়ে গেছে। মনে হলো, আমাদের কর্মসূচি পিছিয়ে দেওয়া মানে কৌশলগতভাবে আমাদের পিছিয়ে যাওয়া, আরও বেশি হতাহতের আশঙ্কা বজায় রাখা।’

‘আমরা প্রতিদিন একটা করে কর্মসূচি ঘোষণা করি, আর এক-দেড় শ মানুষ শহীদ হয়। ৪ আগস্ট বিকেলের দিকে যখন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন আমি “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচিটা এগিয়ে আনার কথা ভাবি। কাদের, মাসউদ আর রিফাত আমাকে বলছিল, বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখা যায় কি না। সিদ্ধান্ত যে পরিবর্তন করব, নাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তো যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন। সেদিন তিনি অনলাইনে আসেন রাত ১১টা-১২টার দিকে। এই পরিস্থিতির কারণে যে সিদ্ধান্তগুলো হয়, সেগুলো আমি প্রায় একাই নিতে বাধ্য হই। পরের সারির কর্মীরা বলল, মাঠের যে পরিস্থিতি তাতে পরের দিনই লংমার্চের ঘোষণা দিলে সেটা সফল করা সম্ভব। ততক্ষণে বিকেল ৪টা বা ৫টা বেজে গেছে। মনে হচ্ছিল, ওই সময়ে ঘোষণা দিলে অনেকে ঢাকায় এসে পৌঁছাতেই পারবে না। একটা বড় ভরসা ছিল এই যে ঢাকার জনসংখ্যাই আড়াই কোটির মতো। এমন একটা আন্দোলনে কি অন্তত ৫০ লাখ লোক নেমে আসবে না? তাহলেও তো যথেষ্ট। আমাদের লক্ষ্য ছিল ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো।’

তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে কথার পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আস্থা এল যে “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচিটা ৫ আগস্টে দিলেও সেটা সফল হওয়া সম্ভব। মাথায় ভাবনাটা ছিল এ রকম-৫ আগস্ট ঢাকা দখল, ৬ আগস্ট গণভবন যাত্রা। গণভবন অভিমুখে যাত্রা ব্যর্থ হলে সব শেষ। ওই সিদ্ধান্তটা তাই ভেবেচিন্তে আলাপ-আলোচনা করে নেওয়ার ব্যাপার ছিল। নাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। কোনো ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও করা যায়নি। কিছু কথা হলো বাকের, কাদের, মাসউদ, রিফাত, মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই “মার্চ টু ঢাকা” একদিন এগিয়ে ৫ আগস্টে নিয়ে আসা হলো।’

‘ফেসবুকে আমি পোস্ট করলাম, “পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এক জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করা হলো।” সবাইকে, বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর মানুষকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হলো।’

‘৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ ঢাকা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলো। সন্ধ্যা থেকে ঘোষণা করা হলো কারফিউ। আমরা কারফিউ ভাঙার ঘোষণা দিলাম। সন্ধ্যার আগে খবর পেলাম, কেউ কেউ দুই-তিন হাজার লোক নিয়ে গণভবনের দিকে যাচ্ছে। এটা ছিল এক ধ্বংসাত্মক ধারণা। দুই-তিন হাজার লোক নিয়ে গণভবনে যাওয়া মানে একদিকে মানুষগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, অন্যদিকে আন্দোলনেরও মৃত্যু। ভুল করার মতো কোনো অবস্থা তখন ছিল না। প্রস্তুতি ছাড়া দুই-আড়াই হাজার মানুষ নিয়ে গণভবনে গেলে সেটা ব্যর্থ হয়ে পরদিন সবার মানসিক শক্তি হারিয়ে যেত। অতি দ্রুত কন্ট্যাক্ট পয়েন্ট খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে কথা বললাম।’

চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ সময়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট সন্ধ্যায় পুলিশের গুলিতে শাহবাগে চারজন শহীদ হলেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সেদিন রাতে ফেসবুকে নানা গুজব ছড়াল। তারা প্রচার করল, সমন্বয়কদের পালাতে দেওয়া যাবে না ইত্যাদি।’

‘৪ আগস্ট আমি বাসা থেকে বের হতে পারিনি। এটা শাপে বর হলো। প্রস্তুতি নেওয়ার এবং যোগাযোগের ভালো সুযোগ পেলাম। মুঠোফোনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। ফোনের এয়ারপ্লেন মোড অন না রাখলে গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা ছিল। অনলাইনে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মাঠের পরিস্থিতি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাঠে নেমে পরিস্থিতি বোঝার সুযোগ ছিল না। শাহবাগে থাকলে শুধু শাহবাগের পরিস্থিতিই হয়তো বুঝতাম। সারা দেশের পরিস্থিতি বুঝতে পারতাম না। কারফিউর খবরও হয়তো পেতাম না।’

‘৪ আগস্ট পরের দিনের কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে কৌশলগত জায়গাগুলোতে যোগাযোগ করতে শুরু করি। রাতে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাকে অনুরোধ করলাম তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো দিতে। লোকজন এলে বাস, ট্রাক, গাড়ি এসব লাগবে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।’

‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক

‘ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজনের ঢাকায় আসার খবর পাচ্ছিলাম। সেই রাতে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েমের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। তাকেও তাঁর দলকে অনুরোধ করতে বলি যেন তারা বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের সুবিধাগুলো দেয়। পরে আর এসবের তদারক করার বা খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ আমার হয়নি।’

‘৪ আগস্ট রাত ৮-৯টার দিক থেকেই মানুষ ঢাকায় আসতে শুরু করল। সেই রাতে ছাত্র-জনতার “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য সব রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আহ্বান জানানো হয়েছিল। এর আগে এভাবে কোনো আহ্বান জানানো হয়নি। এক দফা ঘোষণার পরও কেন এ রকম উন্মুক্ত আহ্বান জানানো হচ্ছে না, সেটা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার কোনো বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। ২৭ বা ২৮ জুলাই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আমাদের নেতা-কর্মীরা তো কোটা আন্দোলনে নেই, তাদের কেন ধরা হচ্ছে? এ ধরনের বক্তব্যের একটা প্রভাব তো থেকেই যায়। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে উন্মুক্ত আহ্বান জানানোর ব্যাপারে দ্বিধা কাজ করছিল।’

তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ সময় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা মহাখালী, রামপুরা-বাড্ডা, সায়েদাবাদ, মিরপুর ১০, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, উত্তরাসহ ঢাকার ১০টা স্থান নির্ধারণ করি। কোথায় কোন জেলার মানুষ অবস্থান নেবে, তা-ও নির্ধারণ করা হয়। পুরো পরিকল্পনাটা আমরা সাজাই গণভবনকে কেন্দ্রে রেখে। পরিকল্পনা ছিল, ওই ১০ স্পটে আমাদের ১০ জন লোক থাকবে। সে অনুযায়ী ৫ আগস্ট আন্দোলনের মূল নেতারা সবাই একসঙ্গে ছিলেন না। যেমন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ আলাদা আলাদা স্পটে ছিলেন। যে ১০ জন আলাদা স্পটে ছিলেন, তাদের ১০ জনের ফোন নম্বর ২০-২৫ জনের একটা করে গ্রুপে শেয়ার করা হয়েছিল।’

‘পরিকল্পনা ছিল ওই ১০টা স্পট মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি হয়ে গেলে সব স্পট থেকে মানুষ একসঙ্গে গণভবনের দিকে রওনা দেবে এবং গণভবনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে। কোনো আক্রমণে না গিয়ে গণভবন ঘেরাও করা হবে’…যোগ করেন আসিফ মাহমুদ।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *