মুখরক্ষার রাজকূট, নাকি প্রস্থানের পথ?

জসীম আহমেদ
6 Min Read
লন্ডনে একান্ত বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়

 

লন্ডন বৈঠক যেন একটি দীর্ঘ অচলায়তনের অবসান ঘটিয়ে নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক কেবলই দুই শীর্ষ নেতার একান্ত আলাপচারিতা নয়, এটি নেপথ্যে রয়েছে বৃহৎ রাজনেতিক ও কূটনৈতিক মঞ্চ; আবার নেপথ্যের নেপথ্যে  রয়েছে সমঝোতা, প্রতিযোগিতা ও চানক্য কৌশল।

ঈদুল আজহার একদিন আগে ৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনুস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই নানা দিক থেকে প্রবল চাপ, সংশয় ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

জুলাই অভ‍্যুত্থানের উৎস থেকে উঠে আসা এ সরকার শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল রাজনৈতিক বৈধতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার সংকটে। ইউনূস জামানার সূচনাকে শুরুতে অনেকেই দেখেছিলেন এক ধরনের ‘নৈতিক উদ্ধারের’ প্রতীক হিসেবে—যিনি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে নতুন এক বাংলাদেশ গড়বেন। শান্তিতে এই নোবেল বিজয়ীর আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিল একজন আদর্শিক আইকনে।

কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই চিড় ধরে সেই ইমেজে। তার সরকার ক্রমেই হতে শুরু করে একপক্ষীয়, দূরত্ব বাড়ে বিএনপির সঙ্গে। সদ্য গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের পরোক্ষ হস্তক্ষেপে প্রশাসনিক ব্যর্থতা হয়ে ওঠে প্রকট। আর জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নিয়ামক সেনাবাহিনীর ভেতরেও পাওয়া যায় সন্দেহ ও দ্বিধার আভাস। উপরন্তু বাংলাদেশে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব তুলে ধরে  বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়।

বিশ্লেষণ বলছে, ‘ক্ষমতার বাঘের পিঠের সওয়ারি’ ইউনূসের সামনে মাত্র খোলা ছিল দুটি পথ—

এক. আপস না করে ছাত্রদের জনপ্রিয়তাকে ভিত্তি করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা চালানো এবং সেনাবাহিনীকে কার্যত রাজনৈতিক প্রশাসনের অংশে পরিণত করা; অথবা, দুই. প্রধান রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে ‘সম্মানজনক প্রস্থানের’ পথ তৈরি করা।

লন্ডন বৈঠকের পর দৃশ্যত, ইউনূস দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ সম্ভবত তিনি উপলব্ধি করেছেন, এনসিপি’র অদক্ষ নেতৃত্ব, প্রশাসনিক অস্থিরতা, ও আন্তর্জাতিকভাবে দ্বিধান্বিত সমর্থন নিয়ে তার ‘মিশন’ হয়ে উঠবে খুব শিগগিরিই ‘ইম্পসিবল’!

অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর অবস্থান বরাবরই খুব স্পষ্ট। তাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ‘১৮ মাসের মধ্যেই নির্বাচন’ এবং ‘সেনা বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরানো’। এই ফৌজি  বার্তাটি একদিকে যেমন ‘অসহিষ্ণু রাজনৈতিক অচলাবস্থায়’ অস্বস্তি প্রকাশ করে, তেমনি

‘বেসামরিক কর্মকাণ্ডের’ বিপরীতে নিজেদের পেশাদার মনোভাবও তুলে ধরে। অর্থাৎ,

সামরিক নেতৃত্ব কোনভাবেই রাজনৈতিক আবর্তে দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের জড়ানোকে নিরাপদ মনে করছে না।

লন্ডনে একান্ত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়

এই জটিল সংকটের আপাত অবসান ঘটেছে লন্ডন বৈঠকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক উত্তেজনা কমানোর কৌশল হিসেবে কাজ করেছে ওই সমঝোতা। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মহলের চাপে এটি হয়ে উঠেছে একটি ‘ফেস সেভিং অ্যারেঞ্জমেন্ট’। কিন্তু এর গভীরে কৌশলগত হিসেব-নিকেশগুলো ভবিষ্যতে হতে পারে গণতন্ত্রের পথে আগামীর দিক-নির্দেশনা।

মুহাম্মদ ইউনূসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই বৈঠক তাকে একটি সম্মানজনক প্রস্থান নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। তিনি হয়তো জানেন, তার সরকারের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা এখন এতটাই স্পষ্ট যে, দীর্ঘমেয়াদে তিনি রাজনৈতিকভাবে টিকতে পারবেন না। দুর্বল প্রশাসন, ছাত্রদের মধ্যে ভাঙন, রাজপথে নিয়ন্ত্রণহীন উত্তেজনা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের সীমাবদ্ধতা তাকে বাধ্য করেছে এমন এক পথ খুঁজতে যেখানে তিনি জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতা ছাড়ছেন না—বরং একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ তৈরি করে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের রক্ষক’ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাতে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে, তারেক রহমানের জন্য লন্ডন বৈঠক ক্ষমতার শীর্ষে আরহণের প্রথম ধাপ। দীর্ঘ নির্বাসন ও রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার পর এ বৈঠক তার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পুনরুত্থানের সুযোগ। যদি এই সমঝোতার ফলে একটি আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত, অবাধ নির্বাচন হয়—তবে সেটি বিএনপির জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত এবং রাজনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে। তারেক রহমানের জন্য এটি কেবল রাজনৈতিক ফায়দার প্রশ্ন নয়, বরং তার নেতৃত্ব বৈধতা পাওয়ার একটি ‘ডিপ্লোম্যাটিক ল্যাডার’।

এই সমঝোতা কীভাবে কাজ করবে? বৈঠকে সম্মত হওয়া বিষয়গুলোর বিস্তারিত প্রকাশ হয়নি, তবে রমজানের আগেই একটি জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা এবং নির্দিষ্ট শর্তে সহাবস্থান ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি স্পষ্ট। এতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোট পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস কি শুধুই সরে যাবেন, নাকি একটি পরবর্তী রাজনীতির ভারসাম্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন—এ প্রশ্ন এখনো উন্মুক্ত।

বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এমন একটি আভাসও দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস‍্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগেও পরে আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই।’

তবে আশঙ্কাও আছে। এই বৈঠক যদি কেবল একজনের প্রস্থানকে ‘মেরিট’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য আশার চেয়ে আশঙ্কার বার্তা বয়ে আনবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, সমঝোতার মোড়কে বহুবার কৌশলগত প্রতারণা ঘটেছে। প্রশ্ন রয়ে যায়—লন্ডনের আলো ঝলমলে রুমে যে কথাবার্তা হলো, তা কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, নাকি অভিজাত কূটনীতিকদের আঁকা একটি সংবেদনশীল স্ক্রিপ্ট?

আর নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী রোডম‍্যপ ঘোষনা করার পরও প্রশ্ন থেকেই যাবে, আমরা কি সত্যিই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে হাঁটছি? নাকি আমরা কেবল একজন কৌশলী নায়কের ‘সম্মানজনক প্রস্থান’ নিশ্চিত করতে যাচ্ছি—যার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকজন ফিরে আসবেন এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে?

শেষ কথা হলো—লন্ডন বৈঠক আপাতদৃষ্টিতে একটি স্বস্তির জানালা খুলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে জানালাগুলো দিয়ে আলোর পাশাপাশি ধোঁয়াও ঢোকে। এই আলো আমাদের গণতন্ত্রকে আলোকিত করবে, নাকি আবারও দেশকে ফেলবে কোনো কৌশলী অন্ধকারে—তা নির্ধারণ করবে আগামী কয়েক মাসের রাজনীতি।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *