‘বিষাক্ত বাতাস’ কেড়ে নিচ্ছে হাজারো শিশুর প্রাণ

আরেফিন তানজীব
6 Min Read
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ধুলোয় ভরা একটি রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দুই স্কুলগামী শিক্ষার্থী। ছবি: আনিক রহমান/টাইমস

বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক দূষিত শহর ঢাকা। আর এ তালিকায় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এ দূষণ হাজার হাজার শিশুকে মৃত্যুর ঝুঁকি এবং আজীবন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিষাক্ত বাতাস শিশুদের স্নায়ুবিক বিকাশের ক্ষতি করছে এবং তাদের মানসিক সক্ষমতা নষ্ট করছে, পাশাপাশি শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ তৈরি করছে। যা নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিসের মত দীর্ঘমেয়াদি রোগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের সর্বশেষ গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৯,০০০-এরও বেশি শিশু বায়ু দূষণের কারণে মারা যায়।

গৃহস্থালি বায়ু দূষণ: বিশেষ করে কাঠ, গোবর এবং অন্যান্য কঠিন জ্বালানি দিয়ে রান্নার কারণে যে বায়ু দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে- তা  এই মৃত্যুর একটি বড় অংশের জন্য দায়ী। গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি এখনও সহজলভ্য নয়, সেখানে ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকা শিশুরা নিউমোনিয়া এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে, একই ধরনের গৃহস্থালি বায়ু দূষণ অন্তত এক-চতুর্থাংশ নবজাতকের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) শিশুদের মধ্যে ছয়টি বড় অসংক্রামক রোগ চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে ব্রঙ্কিয়াল হাঁপানি (৩৭ শতাংশ শিশু আক্রান্ত), থ্যালাসেমিয়া ও আয়রন-স্বল্পতা জনিত রক্তশূন্যতা (২৮ শতাংশ), জন্মগত হৃদরোগ (১৯ শতাংশ), মৃগী (১৪ শতাংশ), নেফ্রোটিক সিনড্রোম (২ শতাংশ) এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিসে (১ শতাংশ) শিশু আক্রান্ত হচ্ছে।

শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

প্রফেসর ডা. আবিদ হোসেন মোল্লাহ টাইমস অব বাংলাদেশ’কে বলেছেন, ‘আমাদের শিশুরা একটি বিষাক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠছে। তারা প্রতি মিনিটে ৪০ বার নিঃশ্বাস নেয়, যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা নেয় ২০ বার। অর্থাৎ তাদের ফুসফুস দ্বিগুণ গতিতে আক্রান্ত হচ্ছে।’

তিনি উল্লেখ করেছেন যে ২৫ শতাংশ পাঁচ বছরের নিচের শিশু নিউমোনিয়ায় ভুগছে।

২০২৪ সালের স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মত দেশ গুলোতে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণজনিত মৃত্যুর ৪০ শতাংশই সরাসরি বায়ু দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত।

পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বায়ু দূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আমাদের দেশের শিশুরা বিশেষভাবে ঘরোয়া বায়ু দূষণের দ্বারা আক্রান্ত। গ্রামে প্রায়ই কাঠ এবং জীবাশ্ম জ্বালানিতে রান্না করা হয়। এই ধোঁয়া শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শিশু মৃত্যুর বড় কারণ।

তিনি বলেন, ‘এই জ্বলন্ত ধোঁয়া কার্বন মনোক্সাইড তৈরি করে, যা শিশুর শরীরে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ঢুকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। তাছাড়া, আমাদের বাইরের দূষণে সীসা এবং সিএফসি থাকে, যা শিশুদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।’

আইসিডিডিআরবি সম্প্রতি এক গবেষণায় জানিয়েছে, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ অসংক্রামক রোগগুলো একটি সমন্বিত ও প্রমাণ-ভিত্তিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর জন্য ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো শিশুদের সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় চিকিৎসা সেবা প্রোটোকল তৈরি করেছে। ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই মডেল কিশোরগঞ্জের ১২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বাগেরহাটের ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশাপাশি দুটি জেলা হাসপাতালে চালু করা হয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে একীভূত করা সম্ভব হবে।

আইসিডিডিআরবি -এর সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডা. আলিয়া নাহিদ টাইমস অব বাংলাদেশ-কে বলেছেন যে, এই গবেষণা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের অসংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি টেকসই এবং সম্প্রসারণযোগ্য মডেলের ভিত্তি তৈরি করেছে, যা শিশুদের বর্তমান স্বাস্থ্যের পাশাপাশি ভবিষ্যতে  তাদের সুস্থ ও উৎপাদনশীল জীবনের সম্ভাবনাকেও রক্ষা করবে।

আরও কী করা উচিত জানতে চাইলে পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন বলেন যে, বায়ু দূষণ থেকে বাঁচতে শুধু মাস্ক ব্যবহার যথেষ্ট নয়; দূষণ রোধে আরও বেশি গাছ লাগাতে হবে এবং শিশুদের দূষণমুক্ত পরিবেশে রাখতে হবে।

প্রফেসর ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের সাবেক পরিচালক এবং সাবেক লাইন ডিরেক্টর (হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেমস অ্যান্ড ই-হেলথ), টাইমস অব বাংলাদেশ-কে বলেছেন যে, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তৈরি লিফলেট ব্যবহার করে মায়েদের ও অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে এবং অসংক্রামক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা নিম্নমানের রাস্তা এবং পুরনো যানবাহনকে দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন যে, শীত আসার আগে রাজধানীর সব কাঁচা ও ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, ‘রাস্তার মাটি ঢেকে রাখা এবং পানি ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শহরের বায়ু দূষণের অন্যতম বড় কারণ হলো পুরনো এবং উচ্চ-নিষ্কাশনযুক্ত যানবাহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পুরনো যানবাহন সরিয়ে ২৫০টি নতুন পরিবেশবান্ধব যান সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছে।’

পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞরা আরও জোর দিয়ে বলছেন, শক্তিশালী নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে রূপান্তর এবং অনুন্নত এলাকায় অ্যান্টিবায়োটিক ও নিউমোনিয়া ভ্যাকসিনের প্রসার ঘটাতে হবে শিশুদের জীবন রক্ষার জন্য।

তারা সতর্ক করেছেন, দূষণ রোধ এবং শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অর্জিত অগ্রগতি থেমে যেতে পারে বা পিছিয়ে যেতে পারে।

তাদের নীতিগত প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে: পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে রূপান্তর, যানবাহন ও কারখানায় কঠোর নির্গমন নিয়ন্ত্রণ এবং অনুন্নত এলাকায় অ্যান্টিবায়োটিক ও নিউমোনিয়া ভ্যাকসিনের সুযোগ বাড়ানো।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *