বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা লাঘব ও প্রত্যাবাসন সহজ করতে এই করিডোরের চিন্তা করা হলেও অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক জটিলতার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
জাতিসংঘ গত মার্চে এই করিডোরের প্রস্তাব তোলে এবং সম্প্রতি তারা আবারও এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, করিডোর চালু না হলে রাখাইনে খাদ্য সংকট দেখা দেবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর পরিবেশ তৈরি করাই এই করিডোরের লক্ষ্য। তবে তিনি সতর্ক করেন, চলমান সংঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ”তাৎক্ষণিক ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন” সম্ভব নয়।’
গুতেরেস বলেন, ‘আমাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, যাতে প্রত্যাবাসন কার্যকর হয়।’
‘তবে করিডোর চালু করতে অনুমোদন ও সহযোগিতা অপরিহার্য’, যোগ করেন তিনি।

বর্তমানে মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সংঘর্ষের কেন্দ্রে রয়েছে রাখাইন। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘শর্তসাপেক্ষে’ করিডোর অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও জনগণের মধ্যে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
দেশটির জনগণ মনে করছে, সীমান্তের বাইরে নতুন সংঘাতে জড়ানো উচিত নয়, যখন দেশের ভেতরে বহু সমস্যা সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে। করিডোর স্থাপনের ফলে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ, মাদক পাচার ও চরমপন্থীদের অনুপ্রবেশের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে পরামর্শ না করেই ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার উদ্যোগ ইউনুস সরকারের ওপর অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তৈরি হয়েছে সন্দেহ, তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে ওই উদ্যোগ নিয়েছেন?
তবে পশ্চিমা সূত্র জানিয়েছে, এই করিডোর জাতিসংঘের পরিকল্পনা, যুক্তরাষ্ট্রের নয়।
এ নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা, এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনী কোনো মন্তব্য করেনি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আপত্তি প্রসঙ্গে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদের স্বার্থে আমরা যে কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করব। আমরা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার আরাকান আর্মিকে অপরাধী ঘোষণা করলেও তারাও তাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করছে।’
মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান সোয়ে জানিয়েছেন, ২০১৮-২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছিল, তার মধ্যে ১.৮ লাখকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকি ৭০ হাজার যাচাই বাকি রয়েছে। মিয়ানমার জানিয়েছে, অবশিষ্ট ৫.৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই দ্রুত শেষ করা হবে।

রাখাইনে করিডোর বাস্তবায়ন হলে তা বাংলাদেশে শরণার্থী সংকট ও আর্থিক চাপ অনেক কমাতে পারে। একই সঙ্গে রাখাইনে কার্যত শাসনকারী আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হতে পারে।
বাংলাদেশ স্পষ্ট করেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আগে তাদের আরাকান সরকারের অংশীদারিত্ব, নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় কাউকে ফেরত পাঠানো হবে না। এই শর্তের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সরকারের জন্য এটি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাত্র ১৫ বছরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন রাজ্যের ১৭টির মধ্যে ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও ৯০ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তও তাদের দখলে রয়েছে। আরেক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান পিপলস রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট (এপিআরজি)-এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য, আইন শৃঙ্খলাসহ নানা খাত পরিচালনা করছে এএ। কনফেডারেশন ধরনের স্বায়ত্তশাসনই তাদের লক্ষ্য।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আরাকানি ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও বৈষম্য। জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও এএ’র মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে এই সম্পর্ক আরও জটিল হয়েছে। তাই সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী আরকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) থেকে মিয়ানমার সামরিক জান্তা যোদ্ধা সংগ্রহ করে শক্তিবৃদ্ধি করছে, যা রাখাইনের বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সক্রিয় হয়েছে সহিংসতার চক্র।
রাখাইন রাজ্যের কৌশলগত অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ (বিআরই) গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিয়াকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও শ্যে গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে চীনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করছে।
তবে মিয়ারমারের গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে চীনের বিনিয়োগ পড়েছে হুমকিতে। ‘অপারেশন ১০২৭’-এর পর বিদ্রোহীরা চীনা অর্থায়িত ৩৪টি প্রকল্পের মধ্যে ২৩টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিনিয়োগ রক্ষায় চীন ও মিয়ানমার জান্তা যৌথ নিরাপত্তা কোম্পানি গঠন করেছে, যা স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে।
ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এএ’র দখলদারি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ সুযোগও তৈরি করেছে। ভারতের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এএ-এর কাছ থেকে নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা যেতে পারে। এতে ভারত চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পাল্টা ভারসাম্য তৈরি করতে পারবে।
বর্তমানে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার জান্তার সম্পর্ক ভালো হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। তবে রাখাইন সমস্যা সমাধান হলে ভারত উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ঠেকানোর সুযোগ পেতে পারে।