সন্তু লারমার ভারত সফর ঘিরে রহস্য

5 Min Read
১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সইয়ের দু’ মাস পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণ। ফাইল ফটো

পাহাড়ে কী শিগগিরই নতুন করে শুরু হচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি? শান্তিচুক্তির তিন দশক পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে কী অধরাই থেকে যাবে কাঙ্খিত শান্তি? সম্প্রতি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)– এই দুই পাহাড়ি গ্রুপের সশস্ত্র তৎপরতা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দিয়েছে এই শঙ্কা। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের পর হঠাৎ করে সাবেক গেরিলা নেতা, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার চলতি ভারত সফর ঘিরে দেখা দিয়েছে আরো প্রশ্ন।

জনসংহতি সমিতির একজন নেতা টাইমস অব বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, পারিবারিক ও স্বাস্থ্যগত কারণে সরকারিভাবে ২৯ দিনের ছুটি নিয়ে ভারতে গেছেন সন্তু লারমা। ছুটির বেশিরভাগ সময় তিনি ভারতেই অবস্থান করবেন।

সরকারি বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত ৩ মে দুপুরে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় গেছেন। সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ছাড়াও ‘মাতৃ-পিতৃ তর্পন ও ধর্মীয় আচারাদি’ সম্পাদন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে তার।

তবে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহ, এটি নিছকই পারিবারিক সফর নয়। আগরতলা থেকে তার কলকাতা এবং দিল্লিও যাওয়ার কথা রয়েছে। কলকাতা তিনি এর আগেও বেশ কয়েকবার  গেছেন। সেখানে তার ছোট কন্যা জুলিয়ানা লারমা ও তার স্বামী, সাবেক শান্তিবাহিনী নেতা প্রধীর তালুকদার বাস করেন। সন্তু লারমা বিভিন্ন সময় কলকাতায় চিকিৎসাও নিয়েছেন। মেয়েকে দেখতে সবসময় বিমানপথে ভারতে গেছেন তিনি। আর প্রতিবারই তার যাত্রা ছিল চট্টগ্রাম-কলকাতা বা ঢাকা-কলকাতা ফ্লাইটে।

সূত্রমতে, গেরিলা জীবনের অবসানের পর আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান পদে দীর্ঘ ২৭ বছরের প্রকাশ্য রাজনীতিতে এবারই প্রথম সড়ক পথে ভারতে গেলেন তিনি। এ নিয়েও রয়েছে নানা কৌতুহল।

এমন এক সময়ে সন্তু লারমা ত্রিপুরা পৌঁছেছেন যখন তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা ও সাধারণ সম্পাদক রবিশংকর চাকমা ত্রিপুরাতেই অবস্থান করছেন। অতিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতা থাকার সময় সন্ত লারমার সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল। তবে গত আড়াই দশকে শান্তিচুক্তিকে ঘিরে সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের রাজনৈতিক সংঘাত প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দুই গ্রুপের সংঘাতে পাহাড়ে অকালে ঝরেছে সহস্রাধিক প্রাণ। পরে দুই গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সমঝোতাও হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রশ্ন রেখে বলছেন, এ পর্যায়ে আবারও পাহাড়ে এই পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো গোপন তৎপরতা শুরু হচ্ছে ? গোয়েন্দা সূত্রগুলোও এমন শঙ্কা খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগে পাহাড়ি দলগুলোর নীতিগত ঐক‍্য হলে পার্বত্যাঞ্চলে যদি নতুন করে উগ্র বিদ্রোহ শুরু হয়, তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতি নাগালের বাইরেও চলে যেতে পারে।

পুরনো একটি ছবিতে ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত খীসা (বামদিকে) এবং সাধারণ সম্পাদক রবিশংকর চাকমা (ডানদিকে)। ছবি: টাইমস

পার্বত্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাহাড়ে এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ৫টি সশস্ত্র গ্রুপ। ইউপিডিএফ (প্রসিত), ইউপিডিএফ (সংস্কারবাদী), জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (লারমা) এবং নাথান বমের নেতৃত্বাধীন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেসিএনএফ)।

ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে ইউপিডিএফ অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে, এ অভিযোগ পুরনো হলেও বরাবরই তারা সশস্ত্র তৎপরতার কথা অস্বীকার করে আসছে।

অন্যদিকে, বছর খানেক আগে কেএনএফ কে নিষিদ্ধ করা হলেও দুবছর ধরে তারা প্রকাশে ফেসবুকে ও ইউটিউবে বান্দরবান ও মিজোরামের একাংশ নিয়ে ‘স্বাধীন কুকি রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে।

ইসলামী জঙ্গিগ্রুপগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি গত বছর বান্দরবানের রুমা ব্যাংক ডাকাতির পর নিরাপত্তা অভিযানে কেএনএফ পিছু হটে। সীমান্ত পেরিয়ে এর গেরিলা সদস্যদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন ওপারে, মিজোরামে।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি, কিছু ভারতীয় রাজ্যভিত্তিক সংস্থা, নাগা ও মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ এবং সন্দেহজনক এনজিও এই গোষ্ঠীগুলোকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। মিয়ানমারের কয়েক বিদ্রোহী গ্রুপের সাথেও তাদের রণকৌশলগত (ট্যাকটিক্যাল অ্যালায়েন্স) যোগসাজস গড়ে উঠেছে কিনা– সেটিও রয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ড. মনিরুল ইসলাম আকন্দ টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুর্ধর্ষ সশস্ত্রগ্রুপ আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও, তাদের সঙ্গে এপারে পাহাড়ের গ্রুপগুলোর অস্ত্র আদান-প্রদান ও ক্যাম্প রক্ষার সমঝোতা রয়েছে।’

‘এই পারস্পরিক যোগাযোগ যদি আরো সক্রিয় হয়, তাহলে সীমান্ত এলাকায় বড় ধরনের সংঘাত তৈরি হতে পারে’, আশঙ্কা তার।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমএ রব টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সীমান্ত পারাপারে সবসময় সক্রিয়। মিজোরামে তাদের নিয়মিত যাতায়াতের তথ্য পাওয়া যায়।’

আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) একাধিক বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পাহাড়ের সীমান্ত অঞ্চলে চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ বিশেষ অভিযান। এসব অভিযানে গত দুই মাসে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি হাতেনাতে আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে। বিদেশিদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা পার্বত্য নাজুক পরিস্থিতি ও সেদিকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের বার্তা দিচ্ছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *