‘কালাকানুন’ কেন বহাল?

admin
By admin
5 Min Read
প্রতীকি ছবি
Highlights
  • ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাত্র তিন বছর পর, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই আইন প্রণীত হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল মজুতদারি, মুনাফাখোরি ও উদীয়মান বিদ্রোহ দমন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর অস্পষ্ট ও ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন ধারা রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

বাংলাদেশে কালাকানুন হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পাওয়া ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে’ জেলবন্দি রাখা হয়েছে শোবিজ মডেল মেঘনা আলমকে। সাম্প্রতিক এ গ্রেপ্তারের ঘটনায় আবারও বিতর্কিত আইনটি জাতীয় আলোচনায় উঠে এসেছে।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই আইনটি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। আইন হিসেবে এর অপব্যবহার আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। বহুবার এই আইন বাতিলের দাবি উঠেছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য।

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাত্র তিন বছর পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই আইন প্রণীত হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল- মজুতদারি, মুনাফাখোর ও  চরমপন্থী দমন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ আইনের ভয়ঙ্কর চেহারা প্রকাশ পেয়েছে। এর অস্পষ্ট ও ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন ধারা রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই আইনে প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও প্রায় একই সংখ্যক মানুষ এই আইনের শিকার হন।

বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা শওকত হোসেন জানান, ২০০০ সাল পর্যন্ত এই আইনে প্রায় ৬৯ হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হন। এরপর হয়তো ব্যবহার কিছুটা কমেছে, তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে এটি কখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন এই আইনে আটক বা গুম হয়েছেন।
চার্জ গঠন বা বিচার ছাড়াই আটকের সুযোগ থাকায় এই আইনকে অনেকেই স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

সব বড় রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন এই আইন বাতিলের দাবি জানালেও, কেউই ক্ষমতায় গিয়ে এটি বাতিল করেনি। যে যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সবাই বিশেষ এ ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে নিজের স্বার্থে।

এই আইন শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ দেয়, যা ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিমালার লঙ্ঘন। এই আইনের অপপ্রয়োগে হাজার হাজার মানুষ বিশেষ করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকা ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পরও আবার নতুন আটকাদেশ দিয়েছে সরকার। তারা কৌশলে আদালতের আদেশ এড়িয়ে গেছে।

নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদেরকে সংস্কারপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। সাবেক মিস আর্থ বাংলাদেশ মেঘনা আলমের ঘটনাটি ঘটেছে তাদের সময়েই। আর সে কারণেই মেঘনার আটকাদেশের ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার।

মেঘনা আলমকে আটক করা হয় সাবেক সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে, তাদের সম্পর্ক বাগদান পর্যন্ত গড়িয়েছিল। পরে ওই রাষ্ট্রদূতের আগের বিয়ের কথা জানতে পেরে মেঘনা সম্পর্কটি জনসমক্ষে আনেন। এরপরই পুলিশ তাকে আটক করে। তাকে গ্রেপ্তারের সময় “রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক” ক্ষতির অজুহাত সামনে আনে পুলিশ, যা ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন অনেকে। আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীরা এই গ্রেপ্তারের সমালোচনা করেছেন।

খোদ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটিকে আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ দুই দিন পরেই প্রধান উপদেষ্টার এক প্রতিনিধি এটি “আইনসঙ্গত” বলে দাবি করে বসেছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, “বিশেষ ক্ষমতা আইনের অস্পষ্ট ও অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানকারী ধারাগুলো অতীতে বারবার মানুষকে বিনা অভিযোগে আটক করতে ব্যবহৃত হয়েছে… এটি ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের চরম লঙ্ঘন।”

তারা আরও বলে, ‘মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে যদি কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তা আনুন, না হলে অবিলম্বে মুক্তি দিন। এই আইন পুরোপুরি বাতিল করুন।”

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সারা হোসেন বলেন, “যদি সত্যিই সংস্কার চলমান থাকে, তাহলে এ ধরনের দমনমূলক আইন ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য। এই সরকারের অনেকেই অতীতে এসব আইনের বিরুদ্ধে ছিলেন, এখন নিজেরাই তা ব্যবহার করছেন।”

অর্থনীতিবিদ ও অধিকার কর্মী আনু মুহাম্মদ বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার এখন সেই পুরনো শাসকের মতো আচরণ করছে। এই আইন আর চলতে পারে না, এখনই তা বাতিল করতে হবে।”

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, “সরকারগুলো ক্ষমতা হারানোর ভয় পায়। সেই ভয় থেকেই বিরোধীদের শত্রু বানিয়ে তাদের দমন করতে যেকোনো উপায় নেয়।”

তবে এত সমালোচনা সত্ত্বেও, এই আইন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে জায়গা পায়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশন বা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, যেগুলো ২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত, তাদের কেউই এই আইনের ব্যাপারে সুপারিশ দেয়নি।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য তানিম হোসেন শাওন বলেন, “আইন সংশোধন বা বাতিল করাটা আমাদের কাজ নয়। সেটি সরকারের এখতিয়ার।”

এই আইন পুরোপুরি বাতিলের বিপক্ষে তিনি, সে কথা জানিয়ে তানিম হোসেন বলেন, “আইনের অপব্যবহার রোধ করতে হবে, তবে সম্পূর্ণ বাতিল করাও সবসময় যৌক্তিক নাও হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কাজে আসে।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দমনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ তাদের সর্বশেষ ইশতেহারে আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছে। বিএনপি ২০০১ সালে ও পরবর্তীতে তাদের ঘোষণা করা ‘ভিশন ২০৩০’ ইশতেহারে কালাকানুন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সব রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক শক্তির ‘অপছন্দের’ আইনটি তারপরও রহস্যজনক কারণে এখনও বহাল।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *