লেংথ বলের জাদুতে তাসকিনের ফিরে আসার গল্প

টাইমস স্পোর্টস
5 Min Read
চার মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে সাফল্য পেলে তাসকিনের মতো উদযাপন করাটাই বুঝি নিয়ম! ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

লম্বা একটা সময় ধরে বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম বলটা করার দায়িত্ব ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার কাঁধে। এরপর দিন বদলেছে, মাশরাফি হারিয়ে গেছেন দৃশ্যপট থেকে। ধীরে ধীরে তার জায়গা নিয়েছেন তাসকিন আহমেদ। গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশের পেস বোলিং কালচারে যে যুগবদল হয়েছে, সেটার অন্যতম কান্ডারি এই ডানহাতি পেসার। ইনিংসের প্রথম বলটা তো করেনই, নেতৃত্বও দিচ্ছেন বাংলাদেশের পেস ব্যাটারিকে। 

বাকি পেসারদের মতো চোটের সাথে তাসকিনেরও নিত্য বসবাস। তার ক্যারিয়ারেও চোট-আঘাতের দাগ কম লাগেনি। সেই বাস্তবতা মেনে টেস্ট থেকেও খানিকটা বিরতি নিয়েছিলেন। কিন্তু চোট আর পিছু ছাড়ল কই? সর্বশেষ বাম পায়ের গোড়ালির হাড় বেড়ে যাওয়াতে বেশ ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে, সেটাও গত বছরের শেষদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে। সেই সমস্যা নিয়েই খেলেছেন বিপিএল আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। এরপর আর পারেননি। ডিপিএলে তিন ম্যাচ খেলে মাঠের বাইরে তাকে যেতেই হলো। 

এপ্রিলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের পর মিস করেছেন টানা আরব আমিরাত আর পাকিস্তান সফরও। সেরে উঠতে শুরুতে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ পেলেও ইংল্যান্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেন ভিন্ন পরিকল্পনা। কারণ তাসকিনের গোড়ালিতে যে সমস্যা, অস্ত্রোপচার করলেও সেটা সারার নিশ্চয়তা নেই। তাই ব্যথাটাকে ‘ম্যানেজ’ করে খেলাটাই শ্রেয়। তাসকিনও তাই বিশ্রাম নিয়ে, ওয়ার্কলোড ম্যানেজ করে সেভাবেই খেলছেন। 

মাঝে মাস চারেকের বিরতিতে খানিকটা স্বাস্থ্যবান হয়েছেন তাসকিন। বুধবার শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে তাকে বল হাতে দৌড়াতে দেখে মনে হলো ওজনটাও বেশ বেড়েছে। অবশ্য এই চার মাসের বিরতি তার বোলিংয়ে যে প্রভাব ফেলেনি সেটা প্রমাণ করতে সময় নিলেন মাত্র এক ওভার। ইনিংসের প্রথম ওভারেই নিলেন মেইডেন। গুড লেংথ আর  লেংথের একটু পেছনে বল পিচ করিয়ে টানা হিট করে গেছেন অফস্টাম্প আর অফস্টাম্প লাইনের বাইরের করিডোর। কারণ এই ধরনের ডেলিভারিতেই সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে থাকেন ব্যাটাররা। 

সাফল্য পেতেও বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রথম স্পেলে নিজের তৃতীয় ওভারে ফিরে প্রথম দুটো বল করলেন গুড লেংথেই। তৃতীয় ডেলিভারিও একই লেংথে, তবে খানিকটা বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল। ড্রাইভ করতে গিয়ে বল স্টাম্পে টানলেন নিশান মাদুশকা। তাসকিন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, এই ধরনের ডেলিভারিগুলো খেলতে গিয়ে যথেষ্ট ফুটওয়ার্ক ছিল না মাদুশকার। তাই ইনসাইড এজ কিংবা নিদেনপক্ষে স্লিপ কর্ডেন ক্যাচ পাঠানোর পরিকল্পনায় অফস্টাম্পের বাইরের লাইনটাই বেছে নিয়েছিলেন। 

এক ওভার পর আবার ফিরে প্রথম বলেই তাসকিনের দ্বিতীয় শিকার। ফর্মুলা সেই লেংথ বল। নতুন ব্যাটার কামিন্দু মেন্ডিস ছিলেন স্ট্রাইকে। তাসকিনের জোরের ওপর করা অফ কাটারটা বেশ গ্রিপ করল উইকেটে, ড্রাইভ করতে গিয়ে মিড অফে মিরাজের হাতে ক্যাচ দিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। ডিসিপ্লিন্ড লেংথের সাথে কামিন্দুর হিসেবে গড়বড় করে দিয়েছে তাসকিনের পাওয়া এক্সট্রা বাউন্স। 

তাসকিন মোট তিন স্পেলে বল করেছেন শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে। দ্বিতীয় স্পেলে ইনিংসের ২৪-তম ওভারে ফিরে স্লটে বল দিয়ে আসালাঙ্কার বলে হজম করেছেন ছক্কা। দুই ওভার বল করে ১৪ রান দিয়ে উইকেট পাননি। তৃতীয় স্পেলে ফিরেছেন ডেথ ওভারে। ৪২-তম ওভারে বল করে হাসারাঙ্গার কাছে হজম করলেন দুই চার। প্রথমটা শর্ট ডেলিভারিতে, পরেরটা অবশ্য ভালো একটা ইয়র্কারে। উড়তে থাকা এই হাসারাঙ্গাকে থামালেন তাসকিনই, সেই লেংথ বলের জাদুতে। ফিফথ স্টাম্প করিডোরের বলে লং অনে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন বদকি ফিল্ডার শামীমের হাতে। শেষ উইকেট মাহিথ থিকশানা। ব্যাক অফ আ লেংথের বলে ঠেকাতে গিয়ে টপ এজ হয়ে জাকের আলির হাতে ক্যাচ।  

তাসকিন নিজের বোলিং শেষ করলেন ১০-২-৪৭-৪ ফিগার নিয়ে। প্রত্যাবর্তন ম্যাচের পারফরম্যান্স ব্যবচ্ছেদ করলে লেটার মার্ক তাকে দিতেই হবে। পাওয়ারপ্লেতে শুরুর স্পেলে তছনছ লংকান টপ অর্ডার। দ্বিতীয় স্পেলে ব্রেক থ্রু না পেলেও খরুচে ছিলেন না। ডেথ ওভারে শেষ স্পেলে তিন ওভার বল করে ১৯ রানে দুই উইকেট। শ্রীলংকাও আটকে যায় ২৪৪ রানে। 

অমন বোলিং স্পেলের নেপথ্যে অবশ্য তাসকিনের গ্রাউন্ড ওয়ার্ক আর আগের অভিজ্ঞতার আলোকে পরিকল্পনা আছে বেশ। শ্রীলংকার প্রচণ্ড গরম, ফ্ল্যাট উইকেট আর লংকান ব্যাটারদের সাম্প্রতিক ফর্ম মিলিয়ে ফিরে আসার ম্যাচে তাসকিনের সামনে বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ প্রেমাদাসার উইকেটও ফ্ল্যাট হলেও শুরুর দিকে পেসারদের জন্য একটু সুইং, সিম মুভমেন্ট অফার করে। যদিও গরমের জন্য উইকেট থাকে শুকনো। সেক্ষেত্রে কেবল পেসের ওপর ভরসা না করে টাইট লাইন লেংথ বল করে যাওয়টাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাসকিন তাই গতির সাথে খুব বেশি আপস না করে বল করে গেলেন গুড লেংথে, লেংথের একটু পেছনে। সেটাতেই এলো সাফল্য।

অবশ্য তাসকিনের সফলতার দিনে হতাশায় ডুবিয়েছেন দলের ব্যাটাররা। মাত্র ৫ রানে ৭ উইকেট হারানোর মাশুল বাংলাদেশ দিয়েছে ৭৭ রানে হেরে। তাসকিনের মতো পেসারদের জীবন তো কঠিনই, মাঝে মাঝে সেটা আরো কঠিন করে তোলেন দলের ব্যাটাররা। 

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *