‘সাহস থাকলে নির্বাচনে নামেন’– এই বাক্য আজ বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে যেন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো। সেই তিনি বলছেন নির্বাচনের কথা? ‘যে তিনি এতটা অচেনা’ হয়ে শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য হাজারো মানুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন? সেই তিনি? তিন তিনবার মানুষকে ভোট থেকে বঞ্চিত করে মানুষের তাড়া খেয়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিয়ে এখন তার কণ্ঠে ভোটের চ্যালেঞ্জ!
একজন যেমন তিনিকে তেনা বলেন, এখন সেই তেনার কথা শুনে মাইকেল মধুসূদন দত্তর ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’র কথা মনে পড়ছে। কাব্যের একটি অংশে রাম তারই প্রিয়ংবদা সীতার কথা শুনে আঁৎকে উঠে বলেছিলেন, ‘একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে।’
তেনার কথা শুনেও আঁৎকে উঠছেন অনেকে। যে রামরাজত্ব তারা কায়েম করেছিলেন সেই রাজন্যবর্গ, পণ্ডিত, পুঙ্গব এমনকি পুরোহিতরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে পালানোর আগে সোনা-দানা-মণি-মাণিক্য নিয়ে যেতে পেরেছেন তারা। তাই নিজেরা নিরাপদ থেকে ফেসবুক-ইউটিউবে মন্থরার কথা ছড়িয়ে দিয়ে যে অন্ধ সমর্থককূল ‘আকূল হয়ে বসে আছে’ তাদের নেমে পড়ার কথা বলছেন যাতে তারা আবার সেই মহাসুখের সময় ফিরে পান।
তেনার সাহসের প্রশংসা করছেন অনেকে। প্রশ্ন হলো, এই সাহসের ডাক যখন এলো, তখন কি আসলে কিছুই বাকি ছিল বা আছে? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘আমাদের গেছে যে দিন/ একেবারেই কি গেছে/ কিছুই কি নেই বাকি।’
বাকি কি আসলে আছে? এখন তিনি ভোটের কথা বলছেন? কোথায় ছিলেন আগে?
রবীন্দ্রনাথ না হয় বলতে পারেন: ‘রাতের সব তারাই আছে/ দিনের আলোর গভীরে।’ কিন্তু চর্যার দুই নম্বর পদেই ত আছে: ‘দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই/ রাতি ভইলে কামরু জাই।’ এখনকার বাংলা করলে দাঁড়ায়: ‘দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয়/ (কিন্তু) রাত হলেই সে কামরূপ যায়।’
এখন তিনি নির্বাচনে নামার সাহসের কথা বলেছেন। কিন্তু আগে?
২০১৪ সালের কথাই ধরা যাক। এক ভয়হীন নির্বাচনের আড়ালে চালানো হয়েছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক একপেশে খেলাঘর। একশ ৫৩টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বিরোধী দল ভোটে না এলে, আসলে আগেই ফল ঠিক করে আসতে না দিলে; সেটাকে গণতন্ত্র বলা যায় কীভাবে? সে এক ‘গণতান্ত্রিক একচেটিয়াতন্ত্র’– দেখতে ভোট, ভেতরে গোট (ছাগল)।
কী মজার কথা! আটাত্তর বছর আগে দিল্লি দূর অস্ত হয়ে গেলেও ভোটের গতিপথ ঠিক করতে দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিলেন এক আধুনিক মেমসাহেব। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তখন ঢাকা এসে বলেছিলেন, ‘এজ মেনি এজ পসিবল।’ মানে যত পারো টেনে নিয়ে এসো। এরশাদকে সিএমএইচে ভর্তি করে জাতীয় পার্টির পায়ে দড়ি দিয়ে নির্বাচনমঞ্চে তোলা হলো। গণতন্ত্রের ক্যানভাসে জোর করে আঁকা হল মুখোশ।
সেদিনকার সেই স্মৃতি রোমন্থন করে সুজাতাই আজ নিশ্চয় ‘সবচেয়ে সুখে আছে’ যদিও যাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য এত আয়োজন তিনি আজ তার পুরবাসী।
সুজাতা সিং কি আজ হেলাল হাফিজকে স্মরণ করে বলছেন: ‘ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন/ আগামী মিছিলে এসো/ স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন/ আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো/ ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি/ লাল শাড়িটা তোমার পরে এসো।’
চরম রক্তপাত ঘটিয়ে সব মিছিল থামিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় পলাতকা হয়ে আজ তিনি তার অনুসারীদের আগামী মিছিলে আসার কথা বলছেন। সুজাতার তাতে কী! হয়ত তিনি পালিকা বাজার বা কনট প্লেসে সন্ধান করছেন নাতবউয়ের জন্য লালশাড়ি।
লাল শাড়ির কথায় সেই জনপ্রিয় গানটার কথা মনে পড়ে: ‘ঐ লাল শাড়ি রে/ নিশি রাতে যায় কোন বনে- লাল শাড়ি রে।’
এই প্রসঙ্গ থাকুক। তবে নিশিরাতের কথা মনে হলে মনে পড়ে ২০১৮ সালের নিশিভোটের কথা।
সব দল জানত শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘সরকারি প্রেসনোটের মতো মিথ্যা তোমার প্রেম’ এর মতো তার সব আশ্বাস ছিল মিথ্যায় পরিপূর্ণ নাটক। তারপরও তারা নির্বাচনে গিয়েছিল। হায়! ভোট হয়ে গেল আগের রাতেই। জনতার হাতে ছিল না ব্যালট, ছিল না অংশগ্রহণ, শুধু ছিল সাজানো নাটকের চিত্রনাট্য।
লালন ফকির বলেছিলেন: ‘জাত গেল জাত গেল বলে/একি আজব কারখানা!’… আর তিনি ভোটের নামে খেললেন নতুন এক খেলা। জাত যাওয়ার কথা ভাবেননি একটুও। গণতন্ত্রের মানসকন্যা পরিচিতি পেলেন নিশিভোটকন্যা হিসেবে। তাতে কী! ক্ষমতায় ত তিনি আছেন। সবার কণ্ঠে জয়ধ্বনি।
আর ২০২৪? সে তো পুরোটাই ডামির প্রতিযোগিতা। আবারও ক্ষমতাই মুখ্য। একবার আসল ভোটে আর দুইবার নামকাওয়াস্তে ভোটে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও ‘আশা পূর্ণ হল না’ তার।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ত বলেই গেছেন: ‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়/ আছে যার ভূরি ভূরি।’
আধিপত্যের এই রাজনীতিতে যার সব আছে, সে চায় আরও। চায় এমন এক প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীর গলায় আগে থেকেই রশি বাঁধা।
এখন এসে বলা হচ্ছে, ‘সাহস থাকলে নামেন!’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মর্মবাণীর সার্থক প্রতিবিম্ব তিনি: ‘মম এক হাতে বাঁকা বাশেঁর বাশঁরী আর হাতে রণতূর্য।’
কিন্তু এটাও ত ঠিক যেমনটা লালন ফকির বলে গেছেন: ‘সময় গেলে সাধন হবে না/দিন থাকতে দিনের সাধন কেন করলে না।’…