বাংলাদেশে নির্বাচনের সূচি ও সংস্কারের প্রশ্নে শুক্রবার লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুষ্ঠেয় বৈঠককে ঘিরে নতুন সমঝোতার সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ডরচেস্টার হোটেলে বাংলাদেশ সময় বেলা ২টায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ রূদ্ধদ্বার বৈঠক।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের বর্তমান শাসন প্রধান এবং প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতার মধ্যে এই প্রথমবার হতে যাওয়া এ বৈঠকটি এখন রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায় এ বৈঠকটি হতে পারে ‘টার্নিং পয়েন্ট’।
বৈঠকের প্রধান দিক হচ্ছে– একদিকে রয়েছে নির্বাচনের সময়সূচি ও প্রকৃতি নিয়ে মতপার্থক্য। অন্যদিকে রয়েছে– সরকার গঠনের প্রক্রিয়া, উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা, এবং বিতর্কিত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্ন। ফলে বৈঠকে আলোচনার সম্ভাব্য বিষয়গুলো বেশ বিস্তৃত।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় জানান, ‘একটি ওয়ান টু ওয়ান মিটিং হবে। যদি তারা মনে করেন আরও কেউ যুক্ত হবেন, তবে সেটা তারা নিজেরাই নির্ধারণ করবেন।’
তবে বৈঠকের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত না হলেও জানা গেছে, এটি হতে পারে উন্মুক্ত কাঠামোয়—প্রাথমিকভাবে একান্তে, পরে যৌথ আলোচনায় রূপ নিতে পারে—এমনটাই আভাস দিয়েছে সরকারি ও বিএনপি সূত্র।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা এই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেন। তবে আলোচনা শুরুর আগে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান কিছু সময় একান্তে কথা বলবেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে প্রাধান্য পাবে নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা। জানা গেছে, বিএনপি তারেক রহমানকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা ডিসেম্বরের সময়সীমা থেকে কিছুটা সরে এসে জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারির মতো বাস্তবসম্মত সময় বিবেচনায় রাজি হতে পারে। তবে এপ্রিল নির্বাচন আয়োজনের সময় হিসেবে ‘অযোগ্য’ বলে মনে করে দলটি।
বিএনপির যুক্তি হলো, এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড গরম, ঝড়বৃষ্টি এবং এর আগেই রোজা ও ঈদুল ফিতর থাকায় তখন নির্বাচন হলে তা হয়রানি ও অংশগ্রহণহীনতার ঝুঁকি তৈরি করবে। তাছাড়া ওই সময় এসএসসি পরীক্ষাও থাকে। এই বাস্তবতায় দলটি আশা করে, সরকার সময় পুনর্বিবেচনায় যাবে।
বৈঠকে বিএনপি আরও দুটি বিষয় তুলতে পারে। প্রথমত, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা বিতর্কিত ব্যক্তিদের অপসারণ। দ্বিতীয়ত, স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের সময় থেকে প্রশাসনে আসা সুবিধাভোগীদের দায়িত্ব থেকে সরানো।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে এসব পদক্ষেপ জরুরি।
‘সংস্কার’ এবং ‘জুলাই সনদ’—এই দুটি বিষয়ও আলোচনায় আসতে পারে। যদিও বিএনপি এই বিষয়ে নিজে থেকে আলোচনা তুলবে না, তবে যদি প্রধান উপদেষ্টা উত্থাপন করেন, তাহলে তারেক রহমানকে আলোচনার সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে দলটি জানিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো জুলাই আন্দোলনে যুক্ত দলগুলো মনে করে, এই বৈঠকে বিচার, সংস্কার এবং সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান দরকার।
এই বৈঠককে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে রুহুল কবির রিজভী মনে করেন, এটি হবে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা দেশের রাজনৈতিক গতিপথে সুবাতাস বইয়ে আনতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মনে করেন, এই বৈঠক থেকে জাতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসবে।
মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের সরকারি সফর ও এই উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক বৈঠক নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন কৌতূহল রয়েছে, তেমনি জনগণের মধ্যেও প্রত্যাশা বেড়েছে।
এই বৈঠক থেকে যদি সময়সূচি ও সংস্কার নিয়ে একটি যৌথ গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি হয়, তবে নির্বাচনের পরিবেশ অনেকটাই অনুকূলে আসতে পারে। অন্যথায়, এ বৈঠক নতুন বিতর্ক ও অনাস্থার জন্ম দিতে পারে।
লন্ডনের এই ঘরোয়া বৈঠক এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পথে একটি বড় মোড় ঘোরানোর সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। জনগণ চায়, রাজনৈতিক নেতারা দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে দেশের সংকটময় পরিস্থিতি থেকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি করুন—আলোচনার মাধ্যমে, সমঝোতার ভিত্তিতে।