৫ আগস্ট যেভাবে বেঁচে গেছেন ওবায়দুল কাদের

টাইমস রিপোর্ট
6 Min Read
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথমবারের মতো কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের। ছবি: দ্য ওয়ালের ভিডিও থেকে নেওয়া

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ১০ মাস পর প্রথম কোনো সাক্ষাতকারে ৫ আগস্ট জনতার হাত থেকে নিজের বেঁচে যাওয়ার কাহিনী শুনিয়েছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

‘আমি খুবই ভাগ্যবান। সেদিন আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। মৃত্যু থেকে (মৃত্যুর) অনেক কাছে ছিলাম, আমারই সংসদ এলাকায়,’ এভাবে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারপতন পরবর্তী সময়ের কথা ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়ালের কাছে বর্ণনা করেছেন তিনি।

সংবাদমাধ্যমটির নির্বাহী সম্পাদক অমল সরকারকে দেওয়া ২৩ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের সাক্ষাতকারে ওবায়দুল কাদের নিজেই জানান, কোনো গণমাধ্যমের কাছে প্রথমবারের মতো তিনি ৫ আগস্টের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন।

ওইদিন শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: আমার নিজের বাসা এড়িয়ে (সংসদ ভবন এলাকার) পার্শ্ববর্তী আরেকটা বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন চারদিক থেকে মিছিল আসছিল। ওইটা আসলে ছিল প্রধানমন্ত্রী-গণভবনকেন্দ্রিক।

‘আমরা অবাক হলাম যে সংসদ এলাকাতেও এটা (মিছিল) ছড়িয়ে পড়ে। একটা লুটপাটের লুম্পেন স্টাইলের কতগুলো ঘটনা ঘটে। সেখানে বিভিন্ন ধরণের লোক আসে এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগই মনে হয়েছে এটা কোনো রাজনৈতিক অভ্যুত্থান (না)। এটা লুটপাটের অভ্যুত্থান,’ বলে দাবি করেন ওবায়দুল কাদের।

‘আমি যে বাসাতে (আশ্রয় নেওয়া) ছিলাম তারা সে বাসাতেও হামলা করে। তারা জানতো না যে সেখানে আমি আছি। আমার বাসা তারা লুটপাট করেছে। কিন্তু যে বাসায় আমি গিয়ে আশ্রয় নিলাম সেখানে তারা হামলা করবে এটা আমি ভাবতে পারিনি। সেখানেও দেখলাম যে অনেক লোকজন ঢুকে পড়ে এবং তারা ভাংচুর- লুটপাট করতে থাকে,’ বলে তিনি জানান।

তিনি এটাও জানান যে, সেসময় তিনি স্ত্রীসহ ওই বাসার একটা বাথরুমে লুকিয়ে পড়েন। তার ভাষায় সেখানে অনেকক্ষণ ছিলেন তিনি, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা।

ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, বাসার ভেতরে ঢুকে পড়া জনতা বাথরুমের কমোড, বেসিন এগুলোও লুটপাট করেছে। তাই তারা যে বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন সেটার মুখে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী বারবার বলছিল যে, ‘আমি (ওবায়দুল কাদের) অসুস্থ।’

‘একটা পর্যায়ে তারা এই বাথরুমে যেগুলো (ফিটিংস) আছে সেগুলো লুট করার জন্য জোরপূর্বক প্রবেশের হুমকি দেয়। আমার ওয়াইফ (ওবায়দুল কাদেরকে) জিজ্ঞেস করে যে কী করব? আমি বলি, খুলে দাও। যা হবার হবে।’

ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: বাংলাভিশনের একটি ভিডিও কনটেন্ট থেকে নেওয়া

এতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি হন ওবায়দুল কাদের যিনি আগে বিভিন্ন সময় রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আমরা পালাব না। প্রয়োজনে মির্জা ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব। কী, জায়গা দেবেন তো?’ এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঠাকুরগাঁওয়ে এক জনসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘কাদের সাহেব কোথায় গেলেন? আমার বাসায় আসেন, আমার এলাকাতে আসেন।’

বাস্তবে সংসদ ভবন এলাকার যে বাসায় ওবায়দুল কাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটার বর্ণনা দিয়ে দ্য ওয়ালকে তিনি বলেন: তারপরে সাত আট জন ছেলে ঢুকলো। খুবই আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি-মনোভঙ্গি নিয়ে। তখন হঠাৎ তারা আমার দিকে তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার নেত্রী চলে গেল। আপনি যাননি কেন? আমি কিছু বলছিলাম না।

পরের ঘটনাটা ছিল ওবায়দুল কাদের এবং তার স্ত্রীর জন্য বিস্ময়কর কিন্তু সৌভাগ্যের।

ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ‘এরপর ছেলেদের মধ্যে কী ভাবের উদয় হয়েছে জানি না। তারা আমাকে বলে, আপনার ছবি তুলব। তারপর আমার ছবি তুলতে শুরু করল। সেলফি নিচ্ছিল। ছবি তুলছিল। ছাত্ররা অনেকে আমাকে চেনে তো! কী কারণে তাদের তখন আক্রমণাত্মক যে মনোভাবটা ছিল- সেটা নিমিষে শীতল হয়ে গেল। তারা ঠাণ্ডা মেজাজে তখন কথা বলছিল। এদের মধ্যে আবার এক পর্যায়ে একটা গ্রুপ তারা চেয়েছিল আমাকে রাস্তায় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে। কেউ কেউ আবার এটাও চেয়েছিল যে জনতার হাতে তুলে দিতে।’

‘অবশ্যই তখন মানসিকভাবে ভেতরে ভেতরে খুব ভেঙে পড়েছিলাম,’ উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের তার বেঁচে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: এরপর এরা এদের একটা শার্ট, একটা ব্যাজ, লাল পতাকা শোভিত ব্যাজ লাগিয়ে, মুখে একটা মাস্ক দিয়ে (পরিয়ে) আমাকে হাঁটতে হাঁটতে সংসদ এলাকা থেকে বড় রাস্তা গণভবন অভিমুখী রাস্তায়, ওখানে নিয়ে যায়। ওখানে নিয়ে গেলে হঠাৎ করে কোত্থেকে একটা ট্যাক্সি আসে। একটা ইজিবাইক। সেটা খালি ছিল। ওখানে কোনো গাড়িঘোড়া কিছুই ছিল না। ওটা হঠাৎ করে কেন যেন এসে পড়ল। হয়ত আমার ভাগ্য।

তিনি বলেন: এরা দুজনে আমাকে আর আমার ওয়াইফকে নিয়ে ওটাতে উঠল আর বলতে লাগল– পথে তো অসংখ্য মানুষ– সব জায়গায় চেকআপ, চেকআপ। এরা বলতে লাগল যে আমাদের চাচা। চাচি অসুস্থ– হাসপাতালে নিচ্ছি। ডিস্টার্ব করবেন না। এ করে করে নিয়ে গেল অনেক দূরে একটা জায়গায়। এটা হলো। ভাবতেও পারিনি– ওরা যখন বাথরুমে ঢুকল– বেঁচে থাকব। বেঁচে থাকাটাই সেদিন পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আনএক্সপেক্টেডলি বেঁচে গেছি। দিস ইজ মোস্ট ইম্পরট্যান্ট।

নিজের সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারত সেটাও উল্লেখ করেছেন ওবায়দুল কাদের:  সেসময় এ ছেলেরা যে কোনোভাবে আর্মির হাতে তুলে দিতে পারতো। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ। অনেকে ত আছে আমাদের অপজিশন। মেরে ফেলতে পারতো।

বেঁচে যাওয়ার পর ওবায়দুল কাদের কী করেছেন সেটাও দ্য ওয়ালের কাছে তুলে ধরেছেন ওবায়দুল কাদের: আমি বাংলাদেশেই ছিলাম তিন মাসের মতো। একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিছু করা যায় কিনা। সংগঠিত করা যায় কিনা। বিভিন্ন জায়গায় অসন্তোষ, কর্মচারিদের অসন্তোষ। লোকগুলো তখন রাস্তায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস। সেসময় ভাবলাম যে এদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু করা যায় কিনা। এ চিন্তাতেই তিন মাস পড়ে রইলাম। এরপর একে একে সবাই অ্যারেস্ট হচ্ছে। এবং আমি ত নেত্রীর পরেই। তখনই ২১২টা খুনের মামলার আসামী হয়ে গেছি। আবার এখান (ভারত) থেকেও অনুরোধ আসছিল আমি যেন সতর্কভাবে চলে আসি।

সাক্ষাতকারে আরো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের যাকে সর্বশেষ জনসম্মুখে দেখা গেছে ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট। ওইদিন ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তিনি। সেখানে নিজ দলের কিছু কর্মীর উদ্দেশে বলা তার কথা ‘ওরা কারা, কোত্থেকে এলো?’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *