এই পৃথিবীতে কিছু শব্দ আছে, শুনলেই মনে হয় ভাষার ল্যাবরেটরিতে কেউ কৌতুক মিশিয়ে বানিয়েছে। নিজ ভাষায় যাই হোক, অন্য ভাষাভাষীদের কাছে সেরকমই মনে হয়, বিশেষ করে যদি কাছাকাছি উচ্চারণের কোনো শব্দ থাকে। যেমন: হরমুজ, তরমুজ, খরমুজ। তিনটি শব্দ, তিনটি রকমফের, তিনটি স্বাদ। তবু তিনজনই ‘মুজ’ পরিবারের সম্মানিত সদস্য।
প্রথমে প্রিয় তরমুজের কথা বলি। গ্রীষ্ম এলেই যে ফলটার কথা মনে পড়ে, সে হলো তরমুজ। তরমুজ মানেই ঠাণ্ডা, রসালো ভালোবাসা। কিন্তু সমস্যা একটাই: ফেসবুকে যতই তরমুজ চেনার রেসিপি দেওয়া থাকুক, ভেতরে আসলে কী, সেটা জানার কোনো যন্ত্র আজও আবিষ্কৃত হয়নি। বাইরে যতই সবুজ চকচকে হোক না কেন, কেটে দেখা গেল ভেতরে ফ্যাকাশে। মনে হয় তরমুজটা প্রেমিকার অপেক্ষায় একা রোদে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেই জ্বলে গেছে।
তরমুজের পর আসে খরমুজ। নামটা শুনে অনেকে ভাবে: এটা কি মৌলিক ফল, না নকল তরমুজ? কিছু মানুষ একে পাকা শশা ভাবে, আবার কেউ ভাবে এটা কাঁচা কুমড়া! খরমুজ এমনই এক ফল, যার পরিচয় সে নিজেও ঠিক জানে না। এর স্বাদ মিষ্টি কিনা তা নিয়েও পরিবারে মতভেদ দেখা যায়।
চাচা রফিক একদিন বললেন, খরমুজ হইলো তরমুজের মতো দেখতে, কিন্তু জিহ্বায় পানি আনে না, আনে সন্দেহ।
শিউলি নামে এক শিশু তার রচনায় লিখে বসেছিল: খরমুজ বড় ভালো ভাই, সে নরম হয়, কিন্তু তাকে ভুল বোঝে সবাই।
তাতে হেডমাস্টার স্যার মন্তব্য করেছিলেন, বুঝি সবই। খরমুজ হইলো আমাদের সমাজের মিসআন্ডারস্টুড জিনিয়াস।
খরমুজ নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম, তরমুজেই বেশি। এমনই এক তরমুজ কেটে খালু বলেছিলেন, এই রকম তরমুজ খেয়ে তো আমি হরমুজে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারি!
তখন থেকেই প্রশ্ন: হরমুজ কী? কিংবা কোথায়?
তরমুজ-খরমুজের সঙ্গে মিল আছে বলে মুজ পরিবারের সদস্য হিসেবে হরমুজের কথায় অনেকে বিভ্রান্ত হন। আসলে বিভ্রান্তির এক জন্মদাতা হরমুজ।
সব ভুল দূর করতে প্রথমেই স্পষ্ট করে দিই, হরমুজ কোনো ফল নয়। এটি একটি সামুদ্রিক চ্যানেল বা প্রণালী; ইংরেজিতে যাকে বলে স্ট্রেইট অব হরমুজ। পারস্য উপসাগর থেকে বিশ্বের অর্ধেক তেল পরিবহন হয় এই প্রণালী দিয়ে।

আমাদের পাড়ার চাচারা যতই জ্যাঠা হয়ে থাকুন না কেন, অনেকের জ্ঞান এই পর্যায়ে পৌঁছায় না। তারা ভাবে: হরমুজ নিশ্চয়ই বিদেশি তরমুজের নাম! দামি হবে, লাল হবে। বিদেশ থেকে এসেছে বলে তরমুজ বা খরমুজ না হয়ে এর নাম হয়েছে হরমুজ।
একবার এক কাঁচাবাজারে এক ক্রেতা এক কেজি তরমুজ দেখিয়ে বলল, ভাই, এইটা কি হরমুজ না তরমুজ
দোকানদার বলল, এইটা খরমুজ ত অবশ্যই না, তরমুজও না। এইটা কেবল ভুলমুজ!
আরেকবার চায়ের দোকানে এলাকার চাচারা এই তিন মুজ নিয়ে বিতর্কে নেমে গেলেন।
চাচা কাওসার: তরমুজ খেলে ঠাণ্ডা লাগে, খরমুজ খেলে ঠোঁট বাঁকা হয়, আর হরমুজের নাম শুনলেই মাথা গরম হয়।
চাচা আনোয়ার: ভাইরে ভাই, হরমুজে যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে তরমুজ আসবে কোন নৌপথে? তখন খরমুজ দিয়েই ইফতার করতে হবে!
চাচা রফিক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন: তিন মুজের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হরমুজ। কারণ সে আমি বলব না, তোমরা বুঝে নাও।
কোন যুদ্ধের সময় চাচা এ কথা বলেছিলেন কিনা, মনে করতে পারছি না। তবে এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি হরমুজের উত্তাপ।
আলোচনার যদি সমাপ্ত টানা তাহলে বলতে হয়: তরমুজ খেলে গ্রীষ্ম সহনীয় হয়। খরমুজ পাতে উঠলে আলোচনা চলে। আর হরমুজ নিয়ে ভাবতে বসলে রাজনীতি ঢুকে পড়ে।
তিনটি নাম, তিনটি মাত্রা। তবু একটা জিনিস পরিষ্কার: আমাদের বাঙালি মন এখনও শব্দের প্রেমে বাঁচে।