২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার পর শেখ হাসিনা হয়তো ভেবেছিলেন, তার শাসনের ভিত এতটাই মজবুত যে তা আর নড়বে না।
সে সময় রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ ছিল কিছুটা ভঙ্গুর, অধিকাংশ বিরোধী মতকেও কণ্ঠরোধ করা গেছে, আন্তর্জাতিক মিত্ররা সমালোচনামুখর হলেও হাসিনা সরকারকে বরাবরের মতো সমর্থন দিয়ে আসছিল।
আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও বিদেশি কূটনীতিকদের সহানুভূতিপূর্ণ সহযোগিতাও ছিল। সবমিলিয়ে তখন বিতর্কিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনী বিতর্ক ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যাচ্ছিল।
তবে সব হিসেব-নিকেশ উল্টে দিয়ে ধেয়ে এলো শ্রাবণ বিদ্রোহের ঝড়। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এর সূচনা হলেও শিগগিরই টানা দেড় দশকের পুঞ্জিভূত ক্ষোভে জনতাও যুক্ত হন আন্দোলনে, প্রবল ঝড়ের ধাক্কায় শেষ পর্যন্ত উল্টে যায় হাসিনার মসনদ।
নির্বাসন থেকে প্রধানমন্ত্রী
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা নির্বাসন থেকে দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালে। নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৭৫ সালে প্রায় পুরো পরিবারসহ শেখ মুজিব হত্যার পর হয়ে উঠেন ভবিষ্যত গণতন্ত্রের আশাজাগানিয়া নেত্রী।
১৯৯৬ সালে বিএনপিকে হারিয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সেই মেয়াদে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরসহ কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার হয়। জাতীয় মীমাংসা ও রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তবতায় দেখা দেয় এক ধরনের ভারসাম্য।
২০০৭–০৮ সালে সেনা সমর্থিত জরুরি শাসনের পর ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। এ বিজয় কেবল জাতীয় নেতা নয়, প্রথমবারের মতো করে তাকে করে তোলে একনায়ক শাসক।
তখনও ছিল আশাবাদ। তিনি উন্নয়ন, ডিজিটাল সংযোগ ও জঙ্গিবাদ দমনের প্রতিশ্রুতি দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তার জনপ্রিয়তা বাড়ায়, এর প্রধান আসামি অধিকাংশই , যাদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর।

আওয়ামী দুর্গে হীরকরাণী
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শক্তি বাড়ানোর বদলে রূপ নেয় স্বৈরতন্ত্রে। নির্বাহী ক্ষমতার চাপে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, বিচার বিভাগও হয়ে উঠে বশংবদ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পায়, কথায় কথায় শুরু হয় কণ্ঠরোধ।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে অকারণে গ্রেপ্তার করা হয়, অনেককে গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতে হয়—যা হাসিনার শাসনে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।
একসময়ের প্রশংসিত র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) পরিণত হয় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের ভয়ঙ্কর যন্ত্রে। শেষপর্যন্ত ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকলেও হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন তিনি। এ সময় প্রতিটি নির্বাচনে কারচুপি, বিরোধীদের দমন ও ভয়ভীতির অভিযোগ ওঠে। এ সময় বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনও ছিল একতরফা ভোট, যেখানে বেশিরভাগ প্রতিদ্বন্দ্বীই নির্বাচন বর্জন করেন।
হাসিনার শাসন ক্ষমতার এই ধারাবাহিকতা একটি বৈধতার সংকট তৈরি করে। যতই রাস্তাঘাট, সেতু ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির গল্প শোনানো হয়, জনগণ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, বাস্তবে মুখোমুখি হন বেকারত্ব, দুর্নীতি আর স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর দমননীতির।

বিদ্রোহ এবং পতন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে চাকরিতে কোটার প্রতিবাদে শুরু হওয়া এক ছোট্ট ছাত্র আন্দোলন অল্প সময়েই জাতীয় বিদ্রোহে রূপ নেয়। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ভুলভাবে মূল্যায়ন করে শেখ হাসিনা বরাবরের মতো কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেন। পুলিশ, গোয়েন্দা ও সাদা পোশাকধারীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়, যাতে শত শত নিহত ও হাজারো আহত হন—সরকারদলীয় কর্মীরাও সহিংসতায় অংশ নেন।
এই বর্বরতা আন্দোলন দমনের বদলে আরও জোরালো করে তোলে। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, আর নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী তখন জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়।
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন ভেঙে পড়ে, আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন এবং ৪৩ বছর পর আবারও ভারতেই আশ্রয় নেন, তবে এবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিতাড়িত হয়ে।
রক্তে ধারা পেছনে যায় না
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা যেন এক শোকগাঁথা। শহীদ পিতার কন্যা, দেশের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাত্রা শুরু করে শেষমেশ তিনি নিজেই নিরস্ত্র তরুণদের রক্ত ঝরানোর নির্দেশদাতা হয়ে ওঠেন—এ যেন ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নির্মম উদাহরণ।
তার নেতৃত্বে হওয়া অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা আঞ্চলিক কূটনীতি—সবকিছুই এখন ঢাকা পড়ে গেছে জুলাই–আগস্টের গণহত্যার রক্তে। তার শাসনব্যবস্থা এখন একটি উদাহরণ, কিভাবে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটকে উন্নয়নের মুখোশ পরে স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তর করা যায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেখ হাসিনার পতন একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে যায়: জবাবদিহিহীন ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হলেও শেষ পর্যন্ত জনগণই বিজয়ী হয়। সেনাশাসনের পর যে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের প্রতীক ছিলেন হাসিনা, আজ তার পতন একটি সতর্কবার্তা, লাগামহীন ক্ষমতার অপব্যবহার কিভাবে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ডেকে আনে, তারই জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিচার হয়তো শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু তার রক্তাক্ত উত্তরাধিকার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না।