একটা সময় পর্যন্ত দেশে শিল্প ও কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং যানবাহনের যন্ত্রাংশসহ প্রায় সব রকমের হালকা যন্ত্রাংশ ভারত ও চীন থেকে আমদানি করতে হতো। তবে সময়ের সঙ্গে এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে এসব পণ্য। বিশেষ করে যশোরে গড়ে উঠেছে হালকা প্রকৌশল খাতের অনেক ছোট-বড় কারখানা। দেশেই এসব পণ্য উৎপাদন হওয়ায় আমদানি নির্ভরতা কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ, চাহিদা মিটিয়ে কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা যাচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন অর্জন হচ্ছে তেমনি দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম কম থাকায় উপকৃত হচ্ছেন ক্রেতারাও।
তবে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, সরকারি পৃষ্টপোষকতা না থাকায় এই শিল্প এখনো অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে যশোরে হালকা প্রকৌশল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। সেসময় গুটি কয়েক উদ্যোক্তা নিজের উদ্যোগে কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি করলেও ২০০৪ সালের পর থেকে এই শিল্পের প্রসার ঘটে। বর্তমানে জেলায় ৯৫০টি কারখানায় প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।
এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি, যেমন, ধান মাড়াই মেশিন, বিচুলি কাটা মেশিন, ভুট্টা ভাঙা মেশিন, সেচ পাম্প এবং শ্যালো মেশিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। এছাড়া রাইস মিল, ময়দার মিল, জুট মিল, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও টেক্সটাইল মিলের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। খোয়া ও পাথর ভাঙার মেশিন, ট্রাক্টরের ট্রলি ও লাঙ্গলের মতো নির্মাণ ও কৃষি সরঞ্জামও তৈরি হচ্ছে।
যশোরে আরও তৈরি হচ্ছে যানবাহনের যন্ত্রাংশ, যেমন মোটর গাড়ির ড্রাম, হবস, ইজি বাইক ও রিকশার যন্ত্রাংশ, মুড়ি ভাজা মেশিন, বেকারি আইটেমের মেশিন এবং আখ মাড়াই মেশিন। এ ছাড়াও ফার্নিচার ও কাঠ শিল্পের বিভিন্ন মেশিন এবং বিভিন্ন প্রকার ওয়ার্কশপ মেশিনারি।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি যশোরের সহ-সভাপতি সিরাজ খান মিন্টু বলেন, ‘যশোর এখন দেশের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। এখানকার ছোট-বড় কারখানাগুলো থেকে তৈরি হাজারো পণ্য দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই শিল্পে বার্ষিক লেনদেন ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। আমরা শুধুমাত্র স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছি না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশ করছি। কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়মিত খোয়া ও পাথর ভাঙার মেশিন ভারতে রপ্তানি করছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।’

যশোরে এ শিল্পের প্রথম এবং প্রধান সমস্যা হিসেবে পরিকল্পিত শিল্প পার্কের অভাবের কথা বললেন যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘কারখানাগুলো যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকায় উৎপাদন প্রক্রিয়া, মান নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা হচ্ছে।’
‘একটি আধুনিক শিল্প পার্ক স্থাপন করা গেলে সমস্ত কারখানাকে এক ছাদের নিচে আনা সম্ভব হতো, যা উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিত।’
দক্ষ শ্রমিকের সংকট রয়েছে বলেও আক্ষেপ করলেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, নতুন কর্মী খুঁজে পাওয়া কঠিন। যারা কাজ করতে আসে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে অনেক সময় এবং অর্থ খরচ হয়। যশোরে এই শিল্পে প্রায় ১০ হাজার দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, সরকার স্কুল পর্যায় থেকে কারিগরি শিক্ষা চালু করলে তরুণ প্রজন্ম এই শিল্পের বিষয়ে আগ্রহী হবে।
সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে রিপন ইঞ্জিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া বেশ জটিল। তাই সরকার সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিলে আমরা আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনে কারখানার মান বাড়াতে পারতাম।’
ব্যবসায়ী সমিতির সহ সভাপতি সিরাজ খান মিন্টু বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কেউ কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে পারে না। কিন্তু আমাদের এই শিল্পে কাজ শেখার জন্য কম বয়স থেকেই প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। আমরা ১৪ বছরের বেশি বয়সের কিশোরদের শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। এতে একদিকে যেমন তারা দক্ষ হবে, তেমনি তাদের কর্মসংস্থানও হবে।’
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, যশোরের ৩০০ কারখানায় বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। তাই এই শিল্পের বিকাশে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি এবং চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে সরকারকে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।